করোনায় হাসপাতালগুলোতে যেমন বেড়েছে রোগীর চাপ তেমনি দেখা দিয়েছে চিকিৎসকের কমতি। বরিশালের বরগুনার প্রায় ১২ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসা হলো বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল। এই বিশাল জনবলের চিকিৎসার ভার নেয়া হাসপাতালটি এখন চিকিৎসক সংকটে ধুঁকছে। এখানে ৪৩ চিকিৎসকের স্থানে আছেন মাত্র ৬ জন চিকিৎসক। এত পর্যাপ্ত সেবা পাচ্ছে না রোগীরা।
তবে হাসপাতালের ৫০ শয্যার করোনা ওয়ার্ড সামলাতে ২০ জন চিকিৎসককে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে অন্য হাসপাতাল থেকে সাময়িকভাবে আনা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে মাত্র ৬ জন চিকিৎসককে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, জেলার প্রধান এই হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৪৩ জনের। এর অনুকূলে আছেন মাত্র ৬ জন। বাকি ৩৭টি পদ অনেক দিন ধরে শূন্য। এর মধ্যে ২১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদের ১৮টিই শূন্য। আর চিকিৎসা কর্মকর্তার ১৯টি পদের মধ্যে ১৬টি পদ শূন্য। জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ২১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মধ্যে নাক কান গলা, শিশু, গাইনি, প্যাথলজিস্ট, মেডিসিন, চক্ষু, কার্ডিওলোজিস্ট, অ্যানেসথেটিস্ট, অর্থোপেডিকস, রেডিওলজিস্ট ও সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকের পদ শূন্য।
বর্তমানে যে ৬ চিকিৎসক রয়েছেন তারা হলেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও), একজন হোমিও চিকিৎসক, একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা, সার্জারি ও অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ।
হাসপাতাল সূত্র থেকে পাওয়া
১৯৯৭ সালে হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও শয্যা আর খাবার ছাড়া কিছু বাড়েনি। এর মধ্যেই ২০১০ সালের মে মাসে হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে নতুন ভবনটি উদ্বোধন হওয়ার পর বর্তমানে সেখানে করোনা ইউনিট করা হয়েছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, এই হাসপাতালে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ রোগী ভর্তি থাকেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগে সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়। এরপর প্রশাসনিক কাজ, ময়নাতদন্ত, ধর্ষণের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কাজকর্ম এই ছয়জনকেই সামলাতে হয়। ফলে এত রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া অসাধ্য হয়ে পড়েছে।
ভুক্তভোগীদের ভোগান্তির চিত্র
হাসপাতালের পুরোনো ভবনে বহির্বিভাগে রোগীদের দীর্ঘ সারি। সেখানে এক জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদক কথা বলেন পেটব্যথা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা বরগুনা সদরের ফুলতলা গ্রামের গৃহবধূ আকলিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকালে আইছি। এহন দুপুর বাজে ১২টা। এত্ত রোগী যে একজন ডাক্তারে দেইখ্যা আউগাইতে পারে না। হ্যারা বা হরবে কী।’
বুকে ব্যথা নিয়ে এক সপ্তাহ আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সদরের গৌরিচন্না গ্রামের আমির হোসেন খান (৭০) নামের এক রোগী। তিনি বলেন, ‘এই সাত দিনে ডাক্তার ওয়ার্ডে আইছে তিন দিন। হ্যারপর খবর নাই।’
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সোহারফ হোসেন বলেন, ‘ছয়জন চিকিৎসকের পক্ষে ২৪ ঘণ্টা জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও ভর্তি রোগীদের সামাল দেওয়া দুরূহ। আমরা কীভাবে দিচ্ছি, সেটা বোঝাতে পারব না।’
করোনা ইউনিটের দশাও বেহাল
এই হাসপাতালের করোনা ইউনিটের শয্যাসংখ্যা ৫০। কিন্তু সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতিদিন গড়ে ৮০ জন করোনায় আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। তাদের অধিকাংশই শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসেন। কিন্তু এখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র নেই। তাই বাধ্য হয়ে জরুরি ও মুমূর্ষু রোগীদের বরিশালে পাঠাতে হয়।
এই ইউনিটে সম্প্রতি ২০ জন চিকিৎসককে অন্যত্র থেকে এনে সাময়িক সংযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা থাকলেও অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৬০-এর নিচে নেমে গেলে আইসিইউ ছাড়া কাজ হয় না। ফলে রোগীরা মারা যাচ্ছেন। ১১টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা থাকলেও তা অপ্রতুল।
সদর উপজেলার খাজুরতলা গ্রামের নিজাম হাওলাদার বলেন, আমার মা-বাবাসহ পরিবারের ৪ জন করোনায় আক্রান্ত। তাদের ভর্তি করা হয়েছে। শয্যা না থাকায় মেঝেতে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এই ইউনিটের প্রধান ইমরান আহমেদ বলেন, করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। এখানে একজন চিকিৎসক প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা সেবা দিয়ে থাকেন। চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক রাখতে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো দরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ