পরিবহন বন্ধ রেখে কারখানা খুলে দেয়ার নির্মম সিদ্ধান্তে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে শ্রমিকদের। করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধি-নিষেধ, ঈদুল আজহা উপলক্ষে আট দিন শিথিল রেখেছিলো সরকার। এরপর আবারও ১৪ দিনের কঠোর বিধি-নিষেধ জারি করা হয় ৫ আগস্ট পর্যন্ত, লকডাউনের কারণে যাতায়াত পরিবহন বন্ধ রেখেছে সরকার।
এদিকে ১ আগস্ট থেকে রপ্তানিমুখী কারখানাগুলো খোলার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে শ্রমিকদের জানানো হলে ভোগান্তিতে পড়েছে তারা। যাদের বাড়ি থেকে কর্মস্থলে যাবার পথ ঘাট কেন্দ্রিক, তারা যেমন ভোগান্তিতে পড়েছে জনবল বেশি এবং ফেরি সীমিত হওয়ার কারণে তেমনি উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় যাবার উপায়ই খুঁজে পাচ্ছে না শ্রমিকরা। অন্যদিকে পরিবহন সল্পতার জন্য প্রায় সব শ্রমিকদের কাছেই ভাড়া তাদের সামর্থ্যের বাইরে।
শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরিঘাট জনশ্রোত
কারখানা খুলে দেওয়ার খবরে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করা শ্রমিক-কর্মজীবীরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আগামীকাল রোববার (১ আগস্ট) কাজে যোগ দিতে হবে তাদের। ফলে আজ তীব্র জনস্রোত সৃষ্টি হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটগুলোতে।
শিমুলিয়া-বাংলাবাজার এগুলোর একটি। আজ ভোর থেকেই এই নৌরুটে যাত্রী ও যানবাহনের তীব্র চাপ। নদী পারাপারের হিড়িক পড়েছে ফেরিতে। এসব যাত্রীর অধিকাংশই পোশাক কারখানার শ্রমিক।
এদিকে, শিমুলিয়াঘাটে পৌঁছনো ঢাকামুখী যাত্রী ও পোশাক শ্রমিকরা পরিবহন সংকটে চরম বিপাকে পড়েছেন। সড়কে পুলিশের চেকপোস্ট এড়িয়ে ছোট যানবাহনে ভেঙে ভেঙে ঢাকার পথে আসছেন তারা। ফলে দুই থেকে তিনগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে তাদের। শ্রমিকদের অনেকেই জানান, কারখানায় কাজে যোগ না দিলে তাদের রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় ফিরতে হচ্ছে তাদেরকে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডাব্লিউটিসি) শিমুলিয়া ঘাটের উপ-মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, নৌরুটে ছোট-বড় মিলিয়ে ৯টি ফেরি এখন সচল। শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজারগামী যাত্রীর সংখ্যা কম। ঘাটে যানবাহনের উপস্থিতিও নেই। গাড়ির চাপ না থাকায় জরুরি প্রয়োজনে যেসব গাড়ি পারাপারের জন্য আসছে, তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে না।
শফিকুল ইসলাম আরো বলেন, বাংলাবাজার থেকে শিমুলিয়াঘাটে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ খুব বেশি। বাংলাবাজার ঘাট থেকে আসা প্রত্যেক ফেরিতেই তীব্র চাপ। পোশাক কারখানা খুলছে, তাই হয়তো যাত্রীদের উপস্থিতি বেশি।
হাতিয়ার ঘাটের শ্রমিকদের ভোগান্তি
রোববার (১ আগস্ট) কলকারখানা খোলার খবরে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার শ্রমিকরাও। এক্ষেত্রে সামজিক দূরত্ব রক্ষা করা দূরের কথা ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরার ট্রলারে নদী পার হচ্ছেন। আজ শনিবার (৩১ জুলাই) সকাল থেকেই হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে শ্রমজীবী মানুষের ভিড় দেখা যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভিড় বাড়তে থাকে।
আকরাম হোসেন নামে একজন শ্রমিক এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, জীবিকার প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছি। সরকার ঘোষিত ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন চলছে। এর মধ্যে ঘোষণা এলো রোববার থেকে কলকারখানা খোলা। এখন কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না। তাই বাধ্য হয়ে মাছ ধরার ট্রলারে যাচ্ছি।
আমির হোসেন নামে আরেক শ্রমিক ঐ দৈনিককে বলেন, ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরার ট্রলারে যাচ্ছি। আগের ভাড়া থেকে দ্বিগুণ ভাড়া নিচ্ছে। আগে স্পিডবোটে ৪০০ টাকা দিয়ে যেতাম। এখন এক হাজার টাকা নিচ্ছে।
হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী হাতিয়ায় সকল গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সকাল থেকে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা নলচিরা ঘাট দিয়ে তাদের গন্তব্যে যাচ্ছে।
পরিবহন সল্পতায় গাদাগাদি করে যেতে হচ্ছে শ্রমিকদের; স্বাস্থবিধির বালাই নেই
কঠোর লকডাউনের মধ্যে হঠাৎ পোশাক কারখানা খোলার ঘোষণায় মহাসড়ক ও আঞ্চলিক বাসস্ট্যান্ডগুলোতে কর্মজীবী নারী-পুরুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। যে যেভাবে পারছেন গন্তব্যে ফিরছেন। আজ সকালে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে কর্মস্থলে ফেরা মানুষদের ভিড় দেখা গেছে।
দুপুর ১২টার দিকে ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দেখা গেছে, যাত্রীবাহী বাসে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে জনপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা। ৬-৭টা বাসে যাত্রী তোলা হচ্ছে। সিএনজিচালিত রিকশায় ভূঞাপুর থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে জনপ্রতি ৬০০ টাকা করে।
এ ছাড়া ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে ঢাকামুখী মানুষের ঢল নেমেছে। কর্মস্থলে ফেরা এসব শ্রমজীবী মানুষ খোলা ট্রাক, পিকআপ, প্রাইভেটকার, সিএনজি ও মোটরসাইকেলযোগে গাদাগাদি করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বপাড়, এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড, টাঙ্গাইল বাইপাস, রাবনা বাইপাস, মির্জাপুর অংশে যাত্রীদের ব্যাপক ভিড় রয়েছে। এ সময় পরিবহন না পেয়ে অনেককে হেঁটে যেতে দেখা গেছে। মহাসড়কে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করলেও এ বিষয়ে পুলিশের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
গণপরিবহন চালু না করে কীভাবে পোশাককারখানা খুলে দিলো তা নিয়ে হতবাক শ্রমিকরাও। এখন শ্রমিকরা কীভাবে কর্মস্থলে ফিরবে তা নিয়ে পরিকল্পনার অভাবে ভুগতে হচ্ছে শ্রমিকদের। কিছু যানবাহন পাওয়া যায় তাতেও তিনগুন ভাড়া চাওয়া হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে কাজে যোগদান করতে না পারলে চাকরি থাকবে না।
রফিকুল ইসলাম কাজ করেন ঢাকার একটি পোশাক কারখানায়। কারখানা খোলার ঘোষণা আর কোম্পানি থেকে নির্ধারিত সময়ে কাজে যোগদানের জন্য বলা হয়েছে তাকে। ফলে চাকরি বাঁচাতে পরিবার নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি এক জাতীয় দৈনিককে জানান, কোম্পানি থেকে কারখানা খোলার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এখন চাকরি বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে হলেও কর্মস্থলে ফিরতে হবে।
এ বিষয়ে মহাসড়কের এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
উত্তরবঙ্গ থেকে ফেরার কোনো উপায় পাচ্ছে না শ্রমিকরা
উত্তরবঙ্গের জেলা রংপুরে যে শ্রমিকরা ঈদে বাড়িতে এসেছিলেন, তারা ফেরার জন্য পাচ্ছেন না যানবাহন। কঠোর লকডাউনের কারণে জেলাভিত্তিক বাস চলাচল বন্ধ। ভেঙে ভেঙে যেতে হলেও একদিন সময়ে পৌছানো সম্ভব না কারণ দূরত্বটা ৩০০ কিলোমিটারের। এদিকে মালবাহী ট্রাকে করে যেতে ভাড়া গুণতে হচ্ছে ২০০০ এর কিছু কমবেশি।
অপেক্ষারত এমন অনেক শ্রমিক আছে যাদের বেতন ৫০০০ এর আশেপাশে। অনেক শ্রমিক ঈদের আগে সম্পূর্ণ বেতনও পাননি। তাদের জন্য এই ভাড়া দিয়ে কর্মস্থলে ফেরা প্রায় অসম্ভব। তবে কোনো কথাই শুনতে রাজি নন কারখানা মালিকেরা। যথাসময়ে কর্মস্থলে না পৌছালে চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন কারখানা কর্তৃপক্ষ।
লকডাউনে শিল্প কারখানা খোলায় প্রতিবাদ
সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের সময়ে আগামী ১ আগস্ট থেকে রপ্তানিমুখী সব শিল্প-কলকারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ। শনিবার (৩১ জুলাই) সংবাদ মাধ্যমে সংঘটির সভাপতি হাবিবুল্লাহ বাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলমের পাঠানো এক বিবৃতিতে এই প্রতিবাদ জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, করোনার উচ্চ সংক্রমণের কারণে পরীক্ষা বিবেচনায় প্রতি তিন জনে এক জন শনাক্ত হচ্ছে এবং দুশতাধিক মৃত্যু ঘটছে; আর উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বিবেচনায় নিলে তা দ্বিগুণের বেশি। এরকম অবস্থায় চলমান লকডাউন আরও ১০ দিন বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ অধিদপ্তরের প্রস্তাবের পরও সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১ আগস্ট থেকে রপ্তনিমুখী সব শিল্প-কলকারখানা খুলে দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করে। অথচ ৩ দিন আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে জানানো হয় ৫ আগস্টের আগে শিল্প-কলকারখানা চালু হবে না।
এরপরই মালিকরা সরকারের বিধিনিষেধ ও আইনকে তোয়াক্কা না করে জানিয়ে দেন ১ আগস্টের মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়া না হলে ‘লে-অফ’ ঘোষণা করা হবে। মালিকদের এমন ঘোষণায় আইন অমান্য করার কারণে সরকারকে যেখানে কঠোর হওয়ার কথা, সেখানে শ্রমপ্রতিমন্ত্রী মালিকদের প্রতি অনুনয় করে ছাঁটাই, লে-অফ না করার অনুরোধ জানান। অথচ নিতান্ত পেটের দায়ে জীবিকার খোঁজে রাস্তায় নামা শ্রমিকদের জরিমানা ও শাস্তি দিতে সরকার পিছপা হয়নি।
আরও বলা হয়, শ্রেণি বিভক্ত এই রাষ্ট্রে আবারও এ ঘটনায় প্রমাণ হয় সরকারের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে মালিকদের স্বার্থরক্ষাই বড়! গার্মেন্টস মালিকরা ঈদের আগে শ্রমিকদের সর্বোচ্চ খাটিয়ে ছুটি দেন ঈদের আগের দিন। সেই সময়ই অনেক মালিক ২৭-৩১ তারিখের মধ্যে কারখানায় কাজে যোগ দেওয়ার কথা শ্রমিকদের জানিয়ে দেন। এমনকি অনেক মালিক শ্রমিকদের ঈদ বোনাসও পরিশোধ করেননি। মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি বোনাস পরিশোধে বারবার সরকারের কাছে প্রণোদনা নিচ্ছেন।
ঈদের ছুটি বাদ দিলে মাত্র এক সপ্তাহের কারখানা বন্ধের কথা বললে মালিকরা রপ্তানি আদেশ তথা বিদেশের বাজার হাত ছাড়া হওয়া এবং লোকসানের কথা সামনে আনেন। যদি এত রপ্তানি অর্ডার থেকে থাকে তাহলে শ্রমিকদের মজুরি বোনাস পরিশোধের সময় কেন বার বার লোকসানের অজুহাত তুলে ধরা হয়। উৎপাদন যন্ত্র ও প্রচলিত ব্যবস্থার মালিকের কাছে মুনাফাই শেষ কথা, রাষ্ট্রের বিধিনিষেধ সেখানে তুচ্ছ।
বিবৃতিতে বলা হয়, ২৩ জুলাই থেকে সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথে যাত্রী পরিবহন বন্ধ রয়েছে। জীবিকা রক্ষায় ২২ জুলাই থেকেই অনেকে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই দ্বিগুণ/তিনগুণ ভাড়া দিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ সহ্য করে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করে। আর ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টসহ শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় শুক্রবার রাত থেকেই শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে, রিকশা-ভ্যানে, ট্রাকে, প্রাইভেট গাড়িতে করে রাজধানীমুখী শ্রমিকদের বানের জলের মতো জনস্রোত শুরু হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৭১৪
আপনার মতামত জানানঃ