করোনায় মৃতদের লাশ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ (মমেক) কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি লাশ বহনের জন্য হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফরিদুল হককে ৩০০ টাকা করে দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় বিচার চেয়ে পরিচালক বরাবর একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন বেসরকারি লাশ বহনকারী সাত ব্যক্তি। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) দুপুরে হাসপাতালের অফিস সহকারীর কাছে লাশ বহনকারী রুবেল, হরমুজ, মানিক মিয়া, জামাল, হিরা, শামসু ও কামাল স্বাক্ষরিত আবেনপত্রটি জমা দেওয়া হয়।
এদিকে করোনার প্রতি লাশের জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তার ৩০০ টাকা নেওয়ার তথ্য জানাজানি হলে হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার দাবি করেছেন তারা।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. ওয়ায়েজউদ্দীন ফরাজী বলেন, লাশ বহনকারীদের কাছ থেকে একটি আবেদন জমা হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যা বলা হয়েছে আবেদনপত্রে
বাংলা ট্রিবিউনের সূত্রে জানা যায় আবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে আবেদনকারীরা বিনা বেতনে হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে মারা যাওয়া রোগীদের লাশ বহন করে আসছেন। রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া সেলামি দিয়ে তাদের সংসার চলছিল। করোনাকালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতি লাশ বহনের জন্য তাদেরকে এক হাজার করে টাকা দেওয়ার বিষয়টি নির্ধারণ করে দেন। এভাবেই লাশ বহন করে আসছিলেন তারা।
তবে রোজার ঈদের আগে তারা লাশ বহনের ১০৩টি স্লিপ জমা দেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফরিদুল হকের কাছে। কিন্তু তিনি প্রতি লাশের জন্য ৩০০ টাকা করে কেটে রেখে বাকি টাকা তাদের হাতে তুলে দেন।
আবেদনে আরও বলা হয়, মাঝেমধ্যেই ফরিদুল হক হুমকি দিয়ে লাশ বহনকারীদের থেকে জরিমানার নামে এক থেকে তিন হাজার টাকা করে আদায় করেছেন। জুন মাসের শেষের দিকে প্রতি লাশের জন্য ৩০০ টাকা দিতে অপরাগতা জানানোর পর ১৪৮টি লাশ বহনের স্লিপ জমা দিতে গেলে তিনি ওই স্লিপ জমা নেননি এবং তাদেরকে তাড়িয়ে দেন।
পরে জুলাই মাসের ১ তারিখ লাশ প্রতি এক হাজার টাকা আর দেওয়া হবে না, তাদেরকে মাসিক পাঁচ হাজার টাকার বেতনে লাশ বহনের কাজ করতে হবে বলে জানানো হয়। এই কথা শুনে কাজ করবেন না জানিয়ে লাশ ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেন আবেদনকারী সাত ব্যক্তি। এরপরে ওই সাত ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে জুলাই মাসের শুরুতেই ১০ হাজার টাকা বেতনে নতুন ছয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয় লাশ বহনের জন্য।
যা বলছেন ভুক্তভোগীরা
আবেদনকারীদের কাছে করোনায় মারা যাওয়া ১৪৮ জনের লাশ বহনের স্লিপ এখনও রয়ে গেছে। বর্তমানে বেকার হয়ে অর্থাভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।
লাশ বহনকারী জামাল বলেন, ফরিদ স্যার প্রতি লাশের জন্য ৩০০ টাকা রেখে দিয়ে আমাদেরকে ৭০০ টাকা করে বুঝিয়ে দেন। টাকা রেখে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন তাকে প্রতি লাশ বাবদ ৩০০ টাকা করে দিতে হবে, তা না হলে কাজ করতে পারবো না।
লাশ বহনকারী শামসু (৭০) বলেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে হাসপাতালে লাশ বহন করে সংসার চলছে। এর আগে হাসপাতালের কোনও কর্মকর্তা লাশের জন্য টাকা নেননি। কিন্তু প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফরিদ স্যার যোগদানের পর থেকেই তিনি নানা অনিয়ম করে আসছেন এবং আমাদের লাশ টানার প্রাপ্য টাকা থেকে ৩০০ টাকা করে নিয়েছেন।
টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় এবং এর প্রতিবাদ করায় আমাদেরকে বের করে দিয়ে নতুন লোক নিয়োগ দিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে অন্য আর কী কাজ করে সংসার চলবে, এই নিয়ে রাতে ঘুম হয় না। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
লাশ বহনকারী মানিক বলেন, ৩০০ টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় আমাদের কাছে থাকা ১৪৮টি লাশ বহনের স্লিপ ফরিদ স্যার জমা নিচ্ছেন না। এই টাকাটা পেলে আমরা স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে কয়েকটা দিন ডাল-ভাত খেয়ে কাটাতে পারতাম।
যা বলছেন অভিযুক্ত
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফরিদুল হক বলেন, করোনাকালে প্রতি লাশ বহনের জন্য এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রতি লাশের জন্য ভ্যাট কেটে ৮০০ টাকা করে জুন পর্যন্ত লাশ বহনকারী ব্যক্তিদের পরিশোধ করা হয়েছে। এরপর আর কোনও স্লিপ তারা জমা দেননি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগের সিদ্ধান্ত বাতিল করে মাসিক ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা বেতনে নিয়োগের কথা বললে লাশ বহনকারী ব্যক্তিরা রাজি হননি। পরে তাদের বাদ দিয়ে নতুন করে ছয় জন ব্যক্তিকে ১০ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ