গুটি বসন্তের টিকার আবিষ্কারক ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৮ সালে এ টিকা উদ্ভাবনের স্বীকৃতি পান। তখন পৃথিবীতে গুটি বসন্ত ছিল সবচেয়ে ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধির একটি। এই রোগ যাদের হতো, তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগই মারা যেত। আর যারা বেঁচে থাকতেন, তারা হয় অন্ধ হয়ে যেতেন, কিংবা তাদের মুখে-শরীরে থাকতো মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন।
বৃটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনারই আধুনিক টিকার প্রথম আবিষ্কারক। এ জন্য তাকে ‘ফাদার অব ইমিউনোলোজি’ বলা হয়। ১৭৯৬ সালে ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার আট বছর বয়সী একটি বালকের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে সাফল্য পান। দুই বছর পর ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়।
গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসা দিতে গিয়ে জেনার দেখতে পান যে, খামারিরা গোবসন্তে আক্রান্ত হলে তাদের সামান্য ফুসকুড়ি দেখা দেয় শুধু। জেনার আরও লক্ষ করলেন, এতে করে খামারি ও গোয়ালিনীরা আর মারণব্যধি গুটিবসন্তে আক্রান্ত হচ্ছে না। জেনার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
জেনারের পদ্ধতিটা অন্যরকম ছিল। জেনার টিকা দেবার সময় গো-বসন্তের পুঁজ ব্যবহার করেছিলেন। গো-বসন্ত এক ধরনের মৃদু সংক্রামক ব্যাধি। এতে মানুষের বা গোরুর মৃত্যু হয় না, কয়েকদিন অসুস্থ হয় মাত্র। গো-বসন্তের পুঁজ দিয়ে টিকা নিলে মানবদেহে আসল বসন্ত আর হয় না, তবে গো-বসন্ত হতে পারে।
এক পর্যায়ে ১৭৯৬ সালের মার্চে সারা নেলমস নামের এক তরুণ গোয়ালিনীর গায়ের গোবসন্তের তাজা ক্ষত থেকে জেনার টিকার উপাদান সংগ্রহ করেন। এ উপাদান ব্যবহার করে তৈরি টিকা সর্বপ্রথম জেমস ফিপস নামের আট (বা তেরো) বছর বয়সী এক শিশুর গায়ে পুশ করেন। ফলাফল ইতিবাচক আসে। জুলাই মাসে আবারো শিশুটিকে দ্বিতীয় ধাপে টিকা দেন জেনার। জেনার এ পরীক্ষা অব্যাহত রাখেন এবং আশানুযায়ী ফল পান। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধী টিকার বুনিয়াদ এভাবেই গড়ে দেন এই চিকিৎসা বিজ্ঞানী। এরপর যত রোগের টিকা তৈরি হয়েছে এটিকে অনুসরণ করেই হয়েছে।
গুটি বসন্ত বহু প্রাচীন একটি রোগ। এ রোগের বর্ণনা অনেক ধর্মগ্রন্থেও পাওয়া যায়। এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকাতে এই মহামারির বিস্তৃত ঘটেছিল। এটি মূলত একটি ভাইরাসজনিত ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগ, যা ভেরিওলা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে হয়।
আঠারো শতাব্দীতে ইউরোপ জুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছিল গুটিবসন্তে। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত বসন্ত মহামারিতে। সে সময় ফ্রান্সিসকো হাভিয়ের দি বালমিস স্পেন অধিকৃত লাতিন আমেরিকা ও ফিলিপাইনে টিকাদান করতে এক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
হাভিয়ের দি বালমিস ছিলেন স্পেনের রাজদরবার ও সেনাবাহিনীর চিকিৎসক। রাজা চতুর্থ কার্লোসকে তিনিই স্পেনের উপনিবেশগুলোতে সাম্রাজ্যের খরচে টিকাদান কর্মসূচি চালাতে রাজি করান। জানা যায়, রাজা চতুর্থ কার্লোসের মেয়েও মারা গিয়েছিল গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে।
সময়টা ছিল ১৮০৩ সাল। স্পেনের উপনিবেশগুলোতে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়ার জন্য জাহাজে চেপে বসেন ফ্রান্সিসকো হাভিয়ের দি বালমিস। বালমিসের যাত্রা শুরু হয় উত্তর-পশ্চিম স্পেন থেকে, ২২ জন অনাথ শিশুকে নিয়ে। এ যাত্রায় নার্স ও সেবকের দায়িত্ব পালন করেছিল তারা।
কিন্তু সে সময় টিকা সংরক্ষণের প্রযুক্তি ছিল না। এদিকে, গুটিবসন্তের টিকা কাচের টেস্টটিউবে মাত্র ১২ দিন টিকে থাকত। কাজেই টিকা তাজা রাখার জন্য বিকল্প কৌশল বের করলেন বালমিস। গো-বসন্তের পুঁজ থেকে তৈরি টিকা দিয়ে প্রতি ১০ দিন পরপর দুটি শিশুকে সংক্রমিত করতেন তিনি। ১০ দিন পর আগে আক্রান্ত দুই শিশুর রক্তরস দিয়ে নতুন দুই শিশুকে আক্রান্ত করতেন।
এভাবে গন্তব্যে পৌঁছার আগপর্যন্ত এই শিশুদের রেফ্রিজেটর হিসেবে ব্যবহার করে টিকা তাজা রাখতেন বালমিস। শিশুরা অসুস্থ হলেও মারা যেত না। কাজটাকে বর্বর মনে হলেও সে যুগে এরকম কাজকে স্বাভাবিক চোখেই দেখা হতো। গুটিবসন্তের টিকার আবিষ্কারক জেনার নিজেও তার টিকা প্রথমে আট বছর বয়সী এক ছেলের ওপর প্রয়োগ করে পরীক্ষা করেছিলেন।
প্রথম জাহাজে ওঠা ২২ জন শিশুকে মেক্সিকোতে রেখে বালমিস নতুন ২৬ জন শিশুকে নিয়ে ফিলিপাইনের উদ্দেশে রওনা দেন। কাগজপত্র থেকে জানা যায়, এই শিশুদের বয়স ছিল চার থেকে চোদ্দ বছরের মধ্যে। টাকার বিনিময়ে এসব শিশুর বাবা-মায়েরা তাদেরকে বালমিসের হাতে তুলে দিয়েছিল। এ শিশুদের কয়েকজন ছিল ‘স্প্যানিশ’, বাকিরা মেস্টিজো (মিশ্র রক্তের)।
বালমিসের এই অভিযান শেষে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, মেক্সিকো, ফিলিপাইন ও চীনের তিন লাখ মানুষ বিনাপয়সায় টিকা পায়। যদিও বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও মহামারিবিদ আলবার্তো গার্সিয়া-বাস্তেরিয়োর মতে, দূর-দূরান্তে টিকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত সাশ্রয়ী ও অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত এক উপায় বের করেছিলেন বালমিস।
গার্সিয়া-বাস্তেরিয়ো বলেন, আজকের দিনে টিকা পরিবহনের জন্য শিশুদের ব্যবহার করা নৈতিকভাবে অত্যন্ত গর্হিত কাজ মনে হতে পারে। কিন্তু এ কৌশলের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও সুফল অস্বীকার করার জো নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ