পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুই নেতার বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর এলাকায় মাথাভাঙ্গা নদী থেকে বালু তোলার অভিযোগ উঠেছে। এতে তীরবর্তী জমি ভাঙনের কবলে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সূত্র মতে, খননযন্ত্র (ড্রেজার) দিয়ে দুই মাস ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। গতকাল সোমবার বালু উত্তোলন বন্ধ করে নদীর তীরবর্তী বাড়িঘর ও ফসলি জমি রক্ষার দাবিতে এলাকাবাসী জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা উদীচীর সভাপতি মো. জহির রায়হান, দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মো. মমিনুল ইসলামসহ নেতারা।
বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের চুয়াডাঙ্গা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
সূত্র মতে, চুয়াডাঙ্গায় সরকারঘোষিত কোনো বালুমহাল নেই। কিন্তু মাথাভাঙ্গা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। বালু তোলার স্থানের উত্তর-পশ্চিমে পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের পারকৃষ্ণপুর গ্রাম এবং পূর্ব-দক্ষিণে দর্শনা পৌর এলাকার রামনগর ও কালিদাসপুর অবস্থিত।
অভিযুক্ত দুই নেতা হচ্ছে পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিয়াবুল হক ও পারকৃষ্ণপুর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান। তারা গত মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বালু উত্তোলন শুরু করেন।
জানা যায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গার নির্বাহী প্রকৌশলী দপ্তরের মাধ্যমে মেহেরপুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জহুরুল লিমিটেড বালু উত্তোলনের জন্য লিখিত আবেদন করে। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পারকৃষ্ণপুর গ্রাম থেকে বারাদী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের প্রয়োজনে বালু উত্তোলন করতে মৌখিক অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ জন্য প্রতি ঘনমিটার বালুর দাম ধার্য করা হয় ১০ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতা জিয়াবুল হক ও হাবিবুর রহমান বালু উত্তোলন শুরু করেন। প্রথমে তারা পারকৃষ্ণপুর থেকে বারাদী পর্যন্ত রাস্তার জন্য উত্তোলন শুরু করেন। পরে বালুর বাণিজ্যে নেমে পড়েন। শত শত ট্রাক বালু উত্তোলন করে জেলা ও জেলার বাইরে বিক্রি করতে থাকেন।
এ সম্পর্কে পাউবোর চুয়াডাঙ্গা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ আহমেদ বলেন, জেলা পানিসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক বালু উত্তোলনের মৌখিক অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যন্ত ১০০ ট্রলি বালু উত্তোলন করা হয়েছে, যার আংশিক বিক্রি বাবদ ৫০ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের নদ-নদীর প্রধান সংকটের একটি বালু উত্তোলন। বালু উত্তোলনের ফলে নদীর দুই তীরে শুরু হয়েছে ভাঙন। ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি হুমকির মুখে।
পেছনে তাকালে দেখা যাবে, ঐতিহাসিকভাবেই নির্মাণ কাজের জন্য নদী থেকে বালু তোলা হতো। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের কিছু নদী এজন্য নির্দিষ্ট ছিল। এর বাইরে সারা দেশেই ব্যাপক মাত্রায় বালু উত্তোলন শুরু হয় নব্বইয়ের দশক থেকে। ওই সময় দেশে কংক্রিটের নির্মাণ কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়।
এমনকি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই দশক থেকে ব্যাপক মাত্রায় পাকা বাড়ি-ঘর নির্মাণ চলতে থাকে। রাস্তা-ঘাট পাকা হতে থাকে। স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত ভবন পাকা হতে থাকে। এর ফলে যেমন জাতীয়ভাবে, তেমনই স্থানীয়ভাবে বালুর চাহিদা বাড়তে থাকে। একই সময়ে নিম্নভূমি, জলাভূমি, পুকুর, নালা, এমনকি বিল-ঝিলও ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ চলতে থাকে। ফলে হঠাৎ করেই বালির চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়। আর সহজ উৎস হিসেবে নদীর দিকে নজর দেয় বালু ব্যবসায়িরা।
এই বালু উত্তোলনের কারণে সারা দেশের বিভিন্ন নদীতে হওয়া ভাঙনের ভুক্তভোগী হয়েছে অসংখ্য মানুষ। হারিয়েছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি। তবু প্রশাসনের কোনো হেলদোল নেই।
এই যেমন সম্প্রতিই রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় পদ্মা নদীর ভাঙন কবলিত ক্যানাল ঘাট এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ঝুঁকিতে রয়েছে দুটি রাস্তা ও নদী পাড়ের তিন গ্রামের বহু ঘর-বাড়ি।
বান্দরবানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে নদী ভাঙনে পালটে যায় লামা-নাইক্ষ্যংছড়ি দুটি উপজেলার ভৌগোলিক সীমানা। হুমকির মুখে পড়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কাগজিখোলা খালের দুই পারের অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি এবং ফসলি জমি।
রাঙ্গুনিয়ার ইছামতি নদী থেকে নিয়ম-নীতি না মেনেই উত্তোলন করা হয় বালু। সরকারের ইজারাবিহীন বালুমহাল থেকে বিভিন্ন সময় সরকারি দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পদ-পদবির দোহাই দিয়ে নিয়মিত বালু তোলা হয়। ইছামতি ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন নদী ও খাল থেকে সিন্ডিকেট করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। বালু উত্তোলনের কারণে ভেঙে যায় তীরবর্তী বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে কিন্তু প্রতিকার নেই। প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে প্রভাবশালীদের অবৈধ এই বালু বাণিজ্য।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০১৩
আপনার মতামত জানানঃ