তাজা খবর বলে এখন আর কিছু নেই। সংবাদমাধ্যমগুলো তাজা খবর দেয়ার আগেই তা চলে আসে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউবের মতো সাইটগুলোতে। এসব মাধ্যমের পেছনে আছে টেক জায়ান্টরা, যারা বিপুল অর্থ ঢালছে। পুরো বিশ্বের মানুষের প্রবণতা বিশ্লেষণ করছে এবং ব্যবসার কৌশল নির্ধারণ করছে। প্রযুক্তিনির্ভর এই ব্যবসা কৌশলের সঙ্গে পেরে উঠছে না সংবাদমাধ্যমগুলো।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক, গুগল এবং ইউটিউবের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সহজে পণ্যের প্রচার-প্রচারণায় কাঙ্ক্ষিত মাধ্যম হয়ে উঠছে এই ডিজিটাল মাধ্যমগুলো। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার একচেটিয়া এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে। ছাপা কাগজের চেয়ে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বেশি কার্যকরী, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠায় ইতোমধ্যে বেশ সফলও তারা। ফলে আয় কমে গভীর সংকটে দেশীয় মেইনস্ট্রিম মিডিয়া তথা সংবাদমাধ্যমগুলো। করোনার প্রাদুর্ভাবে এসব গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন আরও কমেছে। এভাবে নানা কারণে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ও সোশাল মিডিয়ার তোপের মুখে খাবি খাচ্ছে অনেক গণমাধ্যম।
সরকার এই সংকট সমাধানে এখনো কোনো পথ খুঁজে বের করতে পারেনি। সমস্যা সঠিকভাবে আমলে নেয়া হয়েছে, এমন নজিরও মেলে না। সম্প্রতি ফেসবুক, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকার অসহায় উল্লেখ করে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এই জায়ান্ট শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্যই ভয়ংকর চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। ওরা দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি শুধু স্থানীয় স্টার্টআপ, গণমাধ্যমের জন্যও হুমকি।
একাধিক বিজ্ঞাপনী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পণ্য ও সেবার বহুমাত্রিক প্রচার-প্রচারণায় ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের বাজার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে ডিজিটাল মার্কেটিং বিজ্ঞাপনের ৬০ ভাগেরই বেশি দখলে থাকে ফেসবুকের। গুগল, ইউটিউবসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের দখলে বাকি অংশ। স্থানীয় গণমাধ্যমসহ কনটেন্ট ডেভেলপারদের ফেসবুক থেকে আয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে।
জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে কেউ যদি ১০০ টাকার বিজ্ঞাপন ফেসবুকে দেয় সেই টাকার প্রায় পুরোটাই বিজ্ঞাপন দেখিয়ে ফেসবুক নিয়ে নেয়। কিন্তু গুগল কিংবা ইউটিউবের ক্ষেত্রে এটি ভাগ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে দর্শক বা পাঠক দেশের পাশাপাশি বিদেশি ওয়েবসাইট বা কনটেন্টও ব্রাউজ করে থাকেন। ফলে এই টাকার বড় একটা অংশ বিদেশি কনটেন্ট প্রকাশকদের কাছে চলে যায়। এতে করে জটিল হিসাব-নিকাশ আর মারপ্যাঁচ শেষে ওই ১০০ টাকার ৫ টাকাও দেশে ফিরে আসে না। এ অবস্থায় ক্রমেই ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার বাড়লেও লাভ হচ্ছে না দেশীয় গণমাধ্যম ও কনটেন্ট পাবলিশারদের।
মূলত ব্যক্তিগত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ উদ্যোগ, এই তিন শ্রেণিতে রয়েছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বিজ্ঞাপনদাতারা। এর মধ্যে ব্যক্তিগত প্রচার-প্রচারণায় অনেকে এসব প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিয়ে অর্থ খরচ করে থাকেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও তাদের পণ্য ও সেবা সম্পর্কে কাঙ্ক্ষিত গ্রাহক খুঁজতে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকে শুধু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিয়ে পণ্য বিক্রি করছেন। এছাড়া দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্রমেই ডিজিটাল বাণিজ্যে ঝুঁকে পড়ছে। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় পর্যায়ে বিজ্ঞাপন প্রচারে প্রথম পছন্দ ফেসবুক। এর পরেই রয়েছে গুগল ও ইউটিউব। এছাড়া ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাটেও অর্থ খরচ করছেন ডিজিটাল বিজ্ঞাপনদাতারা।
দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের অফিস কিংবা জবাবদিহির জায়গা না থাকলেও সরকারের উদার নীতিমালাকে পুঁজি করে দেশ থেকে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করছে এসব প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গণমাধ্যমকে টিকে থাকতে হলে তার কনটেন্ট কিভাবে এসব টেক জায়ান্টের কাছে বিক্রিযোগ্য করে তোলা যায়, সেই পথ বের করতে হবে। এছাড়া সরকারের এক্ষেত্রে করণীয় রয়েছে। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের অন্তত ৬০ ভাগ সরাসরি দেশীয় গণমাধ্যমকে দিতে সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ব্যক্তিগত ও এসএমই পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের ছাড় দিয়ে শীর্ষ বিজ্ঞাপনদাতাদের সহজেই এ ধরনের শর্তের আওতায় আনা সম্ভব।
একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক বাবু মনে করেন, আন্তর্জাতিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রদানের সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশি টেলিভিশনে যেমন বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারে সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে যেন দেশের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন প্রচার না হয় এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। দেশীয় গণমাধ্যমকে বাঁচাতে এখনই সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকার অবশ্য টেক জায়ান্টদের সঙ্গে কোনো ঝামেলা পাকাতে চায় না। কারণ এদের হাতে সবার তথ্যই রয়েছে। ক্রমশ এই প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠছে সরকারের চাইতেও ক্ষমতাধর। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান, বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিকে আমরা উৎসাহিত করি। ফলে দেশে আলিবাবা, উবারের মতো প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। তবে সম্ভাবনাময় স্টার্টআপকে আমরা সহযোগিতা দিচ্ছি।
মিই/আরা/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ