ঈদুল-আজহার আগে কুরবানির পশুর চমড়ার মুল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলো সরকার। তাতে কোনো লাভ হলো না চামড়া শিল্পের। নির্ধারিত দামের চেয়ে কমে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। ফলে প্রকৃত মূল্য না পেয়ে পাইকারি বাজার পোস্তার আড়তের সামনে, বগুড়ার রাস্তায় ও করোতোয়া নদীসহ অনেক স্থানে চামড়া ফেলে দেওয়া হয়েছে।
এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে, যার মধ্যে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষ, ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৭১৫টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
ঢাকা বিভাগে ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩৩টি গরু-মহিষ, ১২ লাখ ৬৫ হাজার ৫৬টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৩৬৩টিসহ মোট ২২ লাখ ৩৯ হাজার ২৫২টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০ লাখ ৭১ হাজার ২৩১টি গরু-মহিষ, ৮ লাখ ২৮ হাজার ৮৬টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ২০১টিসহ মোট ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫১৮টি, রাজশাহী বিভাগে ৬ লাখ ১৬ হাজার ৭৩৩টি গরু-মহিষ, ১২ লাখ ১৬ হাজার ২৮৩টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ১২৯টিসহ মোট ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ১৪৫টি, খুলনা বিভাগে ২ লাখ ৩৯ হাজার ১৪৭টি গরু-মহিষ, ৬ লাখ ১৮ হাজার ৪৪৩টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ১১টিসহ মোট ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৬০১টি, বরিশাল বিভাগে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬২১টি গরু-মহিষ, ১ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৮টি ছাগল-ভেড়াসহ মোট ৪ লাখ ৬১ হাজার ৯৭৯টি, সিলেট বিভাগে ২ লাখ ৯ হাজার ৫৬৯টি গরু-মহিষ, ১ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৪টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৮টিসহ মোট ৪ লাখ ৮ হাজার ৯৪১টি, রংপুর বিভাগে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ২২০টি গরু-মহিষ, ৫ লাখ ৪৮ হাজার ৬৩৯টি ছাগল-ভেড়াসহ মোট ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৮৫৯টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ লাখ ৮০ হাজার ৩২৫টি গরু-মহিষ, ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬১৯টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৩টিসহ মোট ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯৪৭টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে।
লবণ সঙ্কটের কারণে ভোগান্তি
এদিকে প্রতিবারের মত এবারও চমড়া সিন্ডিকেটে পোস্তাসহ দেশব্যাপী আড়ত মালিকরা জড়িয়ে পড়েছেন। চামড়ার মূল্য কমানোর কারসাজি ধরতে চট্টগ্রামের একাধিক আড়তে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর। আবার কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের প্রধান উপকরণ লবণেরও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বস্তা প্রতি ৫শ টাকা দাম বাড়ানো হয়। লবণের এমন সংকটে অনেক আড়তদার ঈদের দিন রাতে চামড়া কিনতে আগ্রহী না হওয়ায় এর মূল্যের আরেক দফা পতন হয়। ফলে উপায় না পেয়ে কেউ কেউ বড় ধরনের লোকসান দিয়েও চামড়া বিক্রি করেন।
লবণ সংকটের কারণে ৫ থেকে ১০ শতাংশ চামড়া নষ্টের আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)। অবশ্য এর দায়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। লবণের সিন্ডিকেটের কারসাজি হচ্ছে কিনা, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সঠিক মূল্য পাচ্ছে কিনা-তা তদারকি করতে ঈদের পরের দিন সাভারের বিসিক চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শন করেছেন শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতান।
কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহণসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় যৌথ সমন্বয় কমিটির সদস্য মো. হাফিজুর রহমান (অতিরিক্ত সচিব) গনমাধ্যমকে বলেন, পশুর চামড়া ঈদের দিন থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়ে। এতে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার যাতে না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজিবি এ ব্যাপারে কঠোর দায়িত্ব পালন করছে। লবণ সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে লবণের কোনো ঘাটতি নেই। সরবরাহ পর্যাপ্ত আছে। কতিপয় ব্যবসায়ী এ ধরনের সংকট সৃষ্টির খবর পেয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর এবং বিসিকের পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ করায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে। এর জন্য অসাধু কয়েক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয়েছে।
চামড়া ব্যাবসায়ীদের ভোগান্তি
ঈদের দিন আকার ভেদে পোস্তায় প্রতি পিস গরুর চামড়া আড়ত মালিকরা কিনেছেন ২৫০ থেকে ৫৫০ টাকায়। এর মধ্যে বড় আকারের চামড়া ৫৫০ টাকা, মাঝারি ৪০০ টাকা ও ছোট চামড়ার দাম দেওয়া হয় ২৫০ টাকা। রূপগঞ্জ থেকে ট্রাকে করে ৩০০ চামড়া পোস্তায় বিক্রি করতে আসেন মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. ফারুক। তিনি বলেন, বিগত এক বছরে সবকিছুর দাম বাড়ছে কিন্তু চামড়ার দাম বাড়েনি। সব চামড়া লোকসান দিয়ে বিক্রি করা হয়।
রায়হান নামের একজন মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, আমি ঢাকার বাইরে থেকে ১৫ লাখ টাকায় আড়াই হাজার পিস চামড়া কিনে এনেছি। কিন্তু চামড়াগুলো বিক্রি করতে পারছি না। লবণ সংকটের কথা বলে কেউ দামই বলছে না।
কামাল হোসেন নামের মৌসুমি ব্যবসায়ী জানান, রাজধানীর উত্তরা থেকে ২৬০ পিস চামড়া নিয়ে বুধবার ১০টায় লালবাগে আসেন। পোস্তায় ব্যাপক যানজটের কারণে আড়তদারের কাছে পৌঁছাতে সকাল ৭টা বেজে যায়। এ কারণে চামড়ার যে দাম পাবেন আশা করেছিলেন তা পাচ্ছেন না।
এদিকে দাম না পেয়ে পোস্তা ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের আশপাশের বেশ কিছু আড়তের মোকামের সামনের প্রধান সড়কে শত শত চামড়া ফেলে রেখে যান মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
তাদের মধ্যে একজন বাদল জানান, ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় গরুর চামড়া সংগ্রহ করে রাত ৮টার দিকে আড়তে বিক্রি করতে যান। কিন্তু আড়তদাররা গড়ে ৩০০ টাকা করে দাম দিতে চান। এরপর দর কষাকষি করতে করতে সময় নষ্ট হয়, রাত গভীর হয়। পরে আড়তদাররা চামড়া পচে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে আড়ত বন্ধ করে চলে যান। তবুও সারা রাত অপেক্ষায় ছিলাম কোনো গতি করা যায় কিনা। শেষ পর্যন্ত ভোরে এসব চামড়া আমরা রাস্তায় ফেলে দেই। আর বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকেও শত শত নষ্ট চামড়া পড়ে থাকতে দেখা গেছে। পরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এগুলো বর্জ্য হিসাবে নিয়ে যান।
বিশেষ ব্যক্তিদের বক্তব্য
কুরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের পর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অনেক জায়গায় চামড়া ফেলে যাচ্ছেন। এসব চামড়া নিয়ে করপোরেশনের কর্মীরা বেকায়দায় পড়েছেন। একটা বিষয় আমরা লক্ষ্য করছি, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করেছেন। সেই চামড়াগুলো হয়তো তারা বিক্রি করতে পারেননি। পরে বিভিন্ন জায়গায়, নর্দমার সামনে, নর্দমার মুখে তারা সেই চামড়াগুলো ফেলে গেছেন। এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।‘
ছমির হানিফ অ্যান্ড সন্সের মালিক হাজী মো. ছমির উদ্দিন বলেন, ৪৬ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করছি। এমন বাজার আর দেখিনি। আজকে গড়ে প্রতিটি চামড়া আমরা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দর দিচ্ছি।
এসএম কামাল অ্যান্ড সন্সের পক্ষে আনোয়ার বলেন, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম গত বছরের তুলনায় প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা বেশি নির্ধারণ করেছে। আমরা নির্ধারিত দাম থেকে ৩ থেকে ৪ টাকা কমে কিনছি। তবে পোস্তার চামড়ার আড়তদাররা এবার চামড়ার বাজার নিয়ে সন্তুষ্ট। তারা কেনা চামড়ায় লবণ লাগিয়ে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যদিও এবার ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকা। কিন্তু এ দাম বেচাকেনা হয়নি কোথাও।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন জানান, শুক্রবার পর্যন্ত চট্টগ্রামের শতাধিক আড়তে দেড় লাখ কুরবানির পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়েছে। এসব চামড়া লবণ মাখিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আর কিছু চামড়া বিভিন্ন উপজেলায় লবণ দিয়ে রাখা হয়েছে যা দু-এক দিনের মধ্যে আড়তে আসতে শুরু করবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী জানান, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ফেলে দেওয়া ৩০০ পিস কাঁচা চামড়া করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা উদ্ধার করেন। পরে এগুলো একটি মাদ্রাসাকে দিয়ে দেওয়া হয়।
ঈদুল-আজহার আগে চামড়ার দাম নির্ধারন করলেও তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ঠিকমত করা হয়নি বলেই এমন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে চামড়া ব্যবসায়ীদের বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২০২৩
আপনার মতামত জানানঃ