মীর মোনাজ হক : ঠিক দুবছর আগে ৪ নভেম্বর, ২০১৮ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইসলাম রক্ষাকারী দল হেফাজ-ই-ইসলাম ‘কওমী জননী’ খেতাবে ভূষিত করে বাঙালিদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলো। আজ দু বছর পরে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নতুন প্রজন্মকে কতটুকু অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে, তার বিশ্লেষণ নিয়েই আমার আজকের এই লেখা।
‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ আয়োজিত এক শোকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কওমি সনদের স্বীকৃতি দেওয়ায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধিতে ভূষিত করেছে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড গওহরডাঙ্গার চেয়ারম্যান ও গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মহাপরিচালক মুফতি রুহুল আমীন। সেদিন ছিলো রোববার, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শোকরানা মাহফিলে এ উপাধি দেওয়া হয়।
গুনীজনেরা নতুন আলোচনা তুলেছেন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি লাখ লাখ কওমি মাদ্রাসার ছেলেদেরকে ‘উদ্ধার করেছেন’ বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর ‘দাওরায়ে হাদিস’কে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দিয়ে। তিনি নাকি তাদের মানবেতর জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে অসাধারন মানবতার পরিচয় দিয়েছেন। এরা এদের নিজের প্লেটের মধেই সীমাবদ্ধ সেই বৃত্তের বাইরে দেখতে পায়না। সারা বিশ্বের রাজনীতি এরা বুঝেনা, জানেনা – তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। সম্প্রতি জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল যেভাবে নিজের অসংখ্য পপুলারিটি থাকা সত্ত্বেও রাজনীতি থেকে ইস্তেফা দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেনো করেছেন সেটা দেখলেই বুঝবেন যে- সরকার জনগনের সেবক আর নেতারা জনগনকে আলোকিত করেন এই দুইয়ের সমন্বয়েই দেশ শাসন হয়; একসময় নতুন প্রজন্মের জন্যে পথ ছেড়ে দিতে হয়। ৪০ বছর আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা, এবার ঘোষণা দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজের বিশাল কর্ম অভিজ্ঞতার বই লিখুক; সেটাই জনগন চায়। কিন্তু তিনি কেনো তেঁতুল হুজুরের সাথে বসে দু’বছর আগে “কওমি জননী” টাইটেল নিতে গেলেন?
“গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ” এগুলো শুধু কথা কথা নয়, প্রতিটি আদর্শের দার্শনিক ব্যখ্যা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দৃষ্টিকোন থেকে।
বাঙালিরা তাদের নিজেদের পরিচয়েই বেঁচে থাকতে চায়, ‘ওয়াহাবিজমের’ আদলে শরীয়া আইনের দেশ বাংলাদেশ দেখতে চায়না। আর তা গনতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্যে শোভনীয় নয়। আমাদের সংবিধানে যে চারটি মুল আদর্শ সংজ্ঞায়িত করা আছে – “গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ” এগুলো শুধু কথা কথা নয়, প্রতিটি আদর্শের দার্শনিক ব্যখ্যা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দৃষ্টিকোন থেকে। বাংলাদেশ সৃষ্টির লগ্নে যখন গনতন্ত্রকে পদদলিত করে স্বৈরাচার পাকিস্তানি সরকার বাঙালিদের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ক্ষমতা না দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো, তখনই গনতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছিলো বাঙালিরা। সমাজতন্ত্র দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সকল মানুষের মাঝে সুষম-বন্টনকেই বোঝানো হয়েছিলো। তেমনি ধর্মনিরপেক্ষতাও সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও স্বাধীনতার একটি শর্ত। আর বাঙলি জাতীয়তাবোধে যা বাংলাভাষা আন্দোলন থেকে শুরু আর মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে সেই জাতীয়তাবাদ ভুলিন্ঠিত হয়েছিলো, লাখ লাখ মানুষের হত্যা ও নারী ধর্ষনের মাধ্যমে। তখনই বাঙলি জাতিয়তাবাদের একটা বিশেষ অর্থ আমাদের কাছে উঠে এসেছিলো। তাই এই চারটি মুল আদর্শ শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেই নয়, সকল বাঙলির কাছে অতি প্রিয় আদর্শিক জায়গা। এখন যখন আরবী সংস্কৃতি অনুকরন করে যাহারা অপসংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে বাঙলি জাতীয়তাবাদের লড়াই। অন্তত মুক্তি বোদ্ধারা তা কখনোই হতে দেবেনা।
শত শত বছরের ট্রাডিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা প্রশাসনিক কাজে ঢোকেন আর মাদ্রাসার ছেলেরা ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করেন। আপনারা কি মনে করেন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েটরা মিনারে উঠে আজান দেবে? আর কওমি মাদ্রাসার কোরান মুখস্থ করা ছেলেরা প্রশাসনিক দায়িত্ব নেবে? যার যেটা কাজ সেটাই করা উচিৎ। মসজিদে ইমাম, মিনারে আজান দেওয়া সেই কাজগুলো কওমি মাদ্রাসার ছেলেরাই ভালো পারে, তার জন্যে দেশে লাখ লাখ মসজিদ মাদ্রাসা আছে, ঠিক যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী গ্রাজুয়েটরা প্রশাসনিক কাজে ও ডিপ্লম্যাট হয়ে বাংলাদেশকে সারা বিশ্বে পরিচিত করবে। এটাই নিয়ম।
দর্জিকে দিয়ে যেমন শেলাইয়ের কাজ করানো হয় তেমনি প্রকৌশলীরা তৈরি করে ইমারত ও কলকারখানা, অথবা ডাক্তাররা মানুষের চিকিৎসা সেবা দেয়, আর কশাইয়ের কাজ প্রাণী জবাই করে মাংশের জোগান দেওয়া। এর বিপরীতটা হলে সমাজ ভেঙ্গে পড়বে। তাই যারা কওমি মাদ্রাসাগুলোর ‘দাওরায়ে হাদিস’কে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ায় হাতেতালি দিচ্ছেন আর এখনো সাফাই গেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে “কওমি জননী” বানিয়ে সুখ অনুভব করতে চান – তাদেরকে রাষ্ট্র গঠনে ফিরে আসার আহবান করি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষন শুনে বাঙালি জেগে উঠেছিল, আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সেই একই উদ্যানে গত দুবছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে শফি হুজুরের মোনাজাত অনুষ্ঠান কি বাঙালিরা একই ভাবে গ্রহন করেছে? ইতিহাস ভুলে গেলে ভালোভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না। আমেরিকার বর্ণবৈষম্যবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রিয় নেতা, বিশ্বনন্দিত মার্টিন লুথার কিং এর মতো জনগণকে যেমন ‘I have a dream’ বা একটি ‘স্বপ্নের কথা’ (দাসপ্রথা বিলুপ্তি) শুনিয়েছিলেন, তেমনি ৭ই মার্চ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনতার উত্তাল মহাসমুদ্রে হাজির হয়ে বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামের উদাত্ত আহ্বান দিয়েছিলেন। সেই দেশে প্রধানমন্ত্রীকে শফি হুজুরের দেওয়া টাইটেল “কওমি জননী” আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কঠোর ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, এবং তা যথার্থই ছিলো।
আজ টের পাচ্ছি হাড়েহাড়ে, সম্প্রতি করোনা মহামারীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ১৫ জন মানুষের বেশি একত্র হওয়া বিপদজনক ও সংক্রামণ ছড়াতে পারে- এই নিষেধাজ্ঞা সারা পৃথিবীতে প্রতিটি দেশই মেনে চলছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার তা মেনে চলার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। যখন দেখি হেফাজতে ইসলাম ৩০ শে অক্টোবর বাইতুল মোকাররম এর সামনে একত্র হয়ে ফ্রান্সের দূতাবাস ঘেরাও করার ঘোষনা দেয় এবং ২ নভেম্বর ৫০ হাজার মানুষ ঢাকার রাস্তায় নেমে জঙ্গি স্লোগানে ফ্রান্সকে হুমকি দেওয়া শুরু করলেও সরকার চুপচাপ ছিলো। কতোটা ভয়াবহ হয়েছে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান। এখন এই হেফাজতের ভয়ে সরকার ভীষণ তটস্থ, সেই সাথে আমরাওও দারুন উদ্বিগ্ন।
‘যতটুকু বলেছেন ক্ষমা চেয়ে সাবধান হয়ে যান, নয়তো ঘাড় মটকে দিতে বেশি সময় লাগবে না।’
এখন এই হেফাজতি দল বাঙালিদের আরো স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়েছে। অতি সম্প্রতি ১৩ ই নভেম্বর শুক্রবার রাজধানীর ধূপখোলা মাঠে তৌহিদি জনতা ঐক্য পরিষদের এক সমাবেশ থেকে ধোলাইপাড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শীর্ষ নেতারা। এব্যাপারে শেখ হাসিনার দলের লোকেরাই এখন চরম বিরোধিতায় এগিয়ে আসছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বিরোধিতাকারী ধর্মীয় সংগঠনটির নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যতটুকু বলেছেন ক্ষমা চেয়ে সাবধান হয়ে যান, নয়তো ঘাড় মটকে দিতে বেশি সময় লাগবে না।’ তাই ক্ষমতাসীনদের কাছে আমারো দাবি, সময় থাকতে সাবধান হয়ে যান, এই হেফাজতিদের মধ্যে বহু রাজাকার ঘাপটি মেরে আছে, সুযোগ পেলেই এরা বাংলাদেশকে আবার তাদের স্বপ্নের পাকিস্থান বানাতে পিছপা হবেনা।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, প্রকৌশলী ও সাংবাদিক। বার্লিন, জার্মানী।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ