সৌদি আরবে বহু দশক ধরে এমন পদ্ধতি চালু ছিল যে নামাজের জন্য আজান শোনামাত্রই বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে ফেলত। নামাজের সময় সারি সারি গাড়িগুলোকে পেট্রোল পাম্পের সামনে অপেক্ষা করতে হতো তেল নেয়ার জন্য। কারণ নামাজ শেষে পেট্রোল পাম্পের কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়া ফার্মেসি, রেস্টুরেন্ট ও সুপার মার্কেটগুলোর ক্রেতা ও বিক্রেতাদের অপেক্ষা করতে হতো নামাজ শেষ হওয়ার জন্য।
কিন্তু সে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। গত শুক্রবার(১৭ জুলাই) সৌদি চেম্বারের জারি করা এক সার্কুলারে জানা যায়, সৌদি কর্তৃপক্ষ নামাজের সময়ও দোকান খোলা রাখার অনুমতি দিচ্ছে। খবর আরব নিউজ, মিডল ইস্ট আই, এএফপি, রয়টার্স।
সৌদি চেম্বার্স এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, নামাজের সময় দোকান খোলার রাখার অনুমতি দিয়েছে দেশটির সরকার।
চেম্বার্সের সভাপতি আজলান বিন আবদুল আজিজ আল-আজলান জানান, ভোক্তাদের কেনাকাটার অভিজ্ঞতা ও পরিষেবার মান বাড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে নামাজের সময় বন্ধ দোকানের সামনে ক্রেতাদের লম্বা লাইন ও ভিড় এড়ানো যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সৌদি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ওই ফেডারেশনের একটি সার্কুলারের বরাত দিয়ে জেদ্দাভিত্তিক দৈনিক সংবাদপত্র ওকাজ বলেছে, ‘করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে লোকজনের ভিড়, গণজমায়েত, ক্রেতাদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করা এড়াতে ও দোকানিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমরা দোকানমালিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতি নামাজের সময়সহ কর্মঘণ্টার পুরো সময় দোকান খোলা রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
করোনাভাইরাস মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে নামাজের সময় বন্ধ দোকানের সামনে ক্রেতাদের লম্বা লাইন ও ভিড় এড়ানো যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সৌদি ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে নামাজের সময় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে সৌদি সরকার নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, চাইলে নামাজের সময়ও দোকানপাট চালু রাখা যাবে। সেক্ষেত্রে কিছু টাকা দিতে হবে। তবে এ নির্দেশনা জারির প্রথম দিকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে পারবে কিনা এ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল।
দেশটির বিশ্লেষকরা বলছেন, এ নির্দেশনার মাধ্যমে যদি নামাজের সময় দোকানপাট বন্ধ রাখার আইন উঠে যায়, তাহলে এটি সৌদি আরবের রক্ষণশীল পরিবেশে একটি উদার সংস্কার বলে বিবেচিত হবে। দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সৌদি সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
সৌদির এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যেরে রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক ও সমালোচক আলি সমির শিহাবি বলেন, নামাজের সময়ও সৌদি আরবে দোকান খোলা রাখার বিষয়টি প্রাত্যহিক জীবনে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব অবসানে একটি প্রতীকী ও বাস্তবিক পদক্ষেপ।
আলি সমির শিহাবি বলেন, নামাজের জন্য দোকান বা বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা এমন এক অজুহাত যার মাধ্যমে পণ্য ও সেবার জন্য ক্রেতাদের দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষায় রাখা হয়। নামাজের জন্য বন্ধ রাখার বিষয়টি সৌদি আরবের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীদের অদক্ষতার প্রধান কারণ।
অপরদিকে আরেক অর্থনীতিবিদ হাবিবুল্লাহ আল-তুর্কিস্তানি আরব নিউজকে বলেন, নামাজের সময়ও সৌদি আরবে দোকান খোলা রাখার বিষয়টিতে কোনো অর্থনৈতিক লাভ নেই। কারণ, শ্রমিকদের দিনের মধ্যবর্তী সময়ে (দুপরের খাবারের জন্য) এমনিতেই ছুটি দিতে হয়। এমনকি নামাজের সময় সৌদি আরবে দোকান খোলা রাখার সিদ্ধান্তের পরও শ্রমিকদের (নামাজে যেতে) ছুটি দিতে হবে আর অন্যান্য কারণেও ছুটি দিতে হবে। এ বিষয়গুলো শ্রমিকদের অধিকারের সাথে সম্পর্কিত।
নামাজের সময় দোকান খোলা রাখার বিষয়টি নিয়ে সৌদি আরবে বহুদিন ধরেই আলোচনা চলছিল।
নামাজের সময় দোকান খোলা রাখা নিয়ে ২০১৯ সালেই সৌদি সরকার নির্দেশনা জারি করে। এবার এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নিল ফেডারেশন অফ সৌদি চেম্বার্স। এ উদ্যোগের ফলে দেশটিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা যাবে।
সৌদি সরকারের নির্দেশনায় নামাজের সময়ও দোকান খোলা রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে সৌদি নাগরিকরা সে সময় বিভ্রান্তিতে পড়েন। ২০১৯ সালের ওই পদক্ষেপকে বিধিনিষেধ শিথিলের ট্রায়াল হিসেবে দেখেন অনেকে।
ওই নির্দেশনার পর থেকে সৌদি আরবের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিশেষ করে রাজধানী রিয়াদে কিছু রেস্তোরাঁ, সুপার মার্কেট ও অন্যান্য দোকানপাট সব সময়ই খোলা থাকে।
এর আগে সৌদি আরবে ফজরসহ পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের সময় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হতো। নামাজের সময় বাধ্যতামূলক শাটডাউনের কারণে দিনে প্রায় দুই ঘণ্টার মতো সময় কাজ থেকে বিরত থাকতে হয় সৌদি কর্মীদের। নামাজের সময় দোকান খোলা রাখলে শাস্তি হিসেবে করাদণ্ড বা অন্য কোনো শাস্তি দিতে পারত সৌদি আরবের ধর্মীয় পুলিশ।
২০১৭ সালে ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের কার্যত প্রধান শাসক হন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এরপর থেকে সৌদি সমাজব্যবস্থায় বৈপ্লবিক কিছু পরিবর্তন আনেন তিনি।
তেলের ওপর সৌদি আরবের নির্ভরতা কমাতে ও ধর্মের ভূমিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার আনেন এমবিএস।
এছাড়া যুবরাজের কথিত ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নে দেশের শ্রমবাজারে নারীদের সম্পৃক্ত করতেও বিধিনিষেধে সংস্কার আনা হচ্ছে। এই ভিশনের অংশ হিসেবেই দেশটির সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি আরামকোতে সম্প্রতি একজন নারী উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪১
আপনার মতামত জানানঃ