ফেনী পৌরসভার কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালামের বর্ণাঢ্য সন্ত্রাসী জীবন সামনে এসেছে সম্প্রতি। গরু লুট করতে না পেরে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আলোচনায় আসেন তিনি। জানা যায় চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। সাড়ে তিন বছরে আগেও ছিলেন যুবদলের কর্মী। ছাত্রলীগ নেতা রতন হত্যা মামলারও আসামি ছিলেন। বিএনপি নেতা ভিপি জয়নালের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন কালাম। যুবলীগে যোগ দিয়েই এক বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতা বনে যান। ছাত্রলীগ নেতাকে খুনের আসামীর এই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
কালামের উত্থানের ইতিহাস
ফেনী-২ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীই আবুল কালামের রাতারাতি এই উত্থানের কারণ। নিজামের হাত ধরেই কালাম আওয়ামী লীগে যোগ দেন। নিজে বাসিন্দা না হলেও তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলরও বানানো হয়েছে। এমনকি সেই ওয়ার্ডে তাকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও করা হয়েছে।
সূত্র মতে, আবুল কালাম ৬ নম্বর সুলতানপুর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হলেও তিনি ৫ নম্বর বিরিঞ্চি ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। সুলতানপুরে তার কোনো বাড়ি, জমি, কোনো ধরনের স্থাপনা বা ব্যবসা নেই।
এ প্রসঙ্গে ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আইনুল কবিরের দাবি, দলের প্রয়োজনেই কালামকে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। দলের স্বার্থেই ওই ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।
২০১৮ সালের আগে আবুল কালাম ফেনী যুবদলের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
‘কিন্তু গরু ব্যবসায়ী খুনের ঘটনাটি খুবই নিন্দনীয় অপরাধ। গতকাল পৌর আওয়ামী লীগ জরুরি সভা করে কালামকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে।’
২০১৮ সালের আগে আবুল কালাম ফেনী যুবদলের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন ফেনী-২ আসনের বিএনপির সাবেক সাংসদ জয়নাল আবদীন (ভিপি জয়নাল)।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা জানান, যুবলীগে যোগ দেওয়ার পর কালামের এত দ্রুত উত্থানের পেছনে রয়েছে সাংসদ নিজাম হাজারীর ‘সুনজর’।
এ প্রসঙ্গে নিজাম হাজারী বলেন, দলে অনেকেই যোগ দিয়েছেন। কালাম তার যোগ্যতার ভিত্তিতে পদ পেয়েছেন। এখন তিনি পদের মর্যাদা রাখতে পারেননি। তার অপকর্মের দায় দল নেবে না।
গরু ব্যবসায়ীকে হত্যা
গত বৃহস্পতিবার রাতে গরু লুটে বাধা দেয়ায় মো. শাহজালাল (৩৫) নামের এক গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ফেনীর গার্লস ক্যাডেট কলেজ রোডের সাহেব বাড়ি এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
কাউন্সিলর কালাম নিজেই গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করেন। তারপর তিনজনে (গ্রেপ্তার দুজনসহ) মিলে লাশটি পুকুরে ফেলে দেন।
এই ঘটনায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম ও তার তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। হত্যার ঘটনার পর কালাম পালিয়ে যান। তার দুই সহযোগী নাইম হাসান ও মো. সাগরকে এই ঘটনায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
এর মধ্যে নাইম গতকাল শনিবার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, কাউন্সিলর কালাম নিজেই গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করেন। তারপর গ্রেপ্তার দুজনসহ কালাম লাশটি পুকুরে ফেলে দেন।
ফেনী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, পৌর কাউন্সিলর কালামকে গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে। ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
খুনের স্বীকারোক্তি
গ্রেপ্তার দুই আসামির মধ্যে নাইম হাসান গতকাল ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। নাইম ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র। তিনি কাউন্সিলর কালামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বীকারোক্তিতে নাইম বলেন, কোরবানি উপলক্ষে বিক্রি করার জন্য শাহজালালের আনা গরু লুট করতে যান তারা। শাহজালাল বাধা দিলে তাকে কালাম গুলি করেন। পরে লাশটি পুকুরে ফেলে দেয়া হয়।
গ্রেপ্তার আরেক আসামি সাগরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে একই আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ফেনী সদর মডেল থানার ওসি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ছাত্রলীগ নেতা হত্যার আসামি
১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর সুলতানপুর এলাকায় যুবদলের মধ্যে সংঘর্ষে ফেনী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন ওরফে রতন নিহত হন। কালাম এই হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।
‘রতন হত্যা মামলার আসামি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে, আবার নেতা হয়েছে। এখন চাঁদাবাজি করছে, মানুষ খুন করছে। এটা খুবই দুঃখজনক।’
ওই ঘটনায় করা মামলাটি পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে আবুল কালামের নাম রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
রতনকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল, সেই এলাকায়ই বৃহস্পতিবার রাতে গুলি করে হত্যা করা হয় গরু ব্যবসায়ী শাহজালালকে।
রতন হত্যার ঘটনা ফেনীতে তখন বহুল আলোচিত ছিল। রতনের বড় ভাই আলমগীর হোসেন হাজারীও (তোতা) ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
আলমগীর হোসেন হাজারী এ প্রসঙ্গে জানান, ‘রতন হত্যা মামলার আসামি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে, আবার নেতা হয়েছে। এখন চাঁদাবাজি করছে, মানুষ খুন করছে। এটা খুবই দুঃখজনক।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬২৫
আপনার মতামত জানানঃ