বাংলাদেশে ই-কমার্সে শুরু হওয়ার পর থেকে প্রথম অবস্থায় সকল প্রতিষ্ঠানগুলো একতালে চললেও হঠাৎ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালি বিশাল পরিমাণ ছাড় নিয়ে নতুনত্ব নিয়ে আসার পর থেকে দেশের ই-কমার্সে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। একে একে ধামাকা শপিং, আলিশামার্ট, শিরাজগঞ্জ শপিংসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালির পলিসি নিয়ে সারা ফেলে বাংলাদেশে।
ই-কমার্স নিয়ে গেল মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনার পর থেকে অনেকটা সমস্যায় পরে যায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে করে ভোক্তাসহ যে সকল উদ্যোক্তারা পণ্য সাপ্লায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেবা প্রদান করে আসছিলো তারা বিল না পেয়ে বিপাকে পরে যায় এবং পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে।
‘ধামাকা শপিং’র চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ
বিভিন্ন ধরনের ৭শ’ পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩শ’ কোটি পাওনা টাকা আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস ধরে ধামাকা তাদের পেইজের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের পণ্য বিক্রি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করলেও তা পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করেনি ধামাকা। পাওনা টাকা না পেয়ে শুক্রবার (১৬ জুলাই) বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ধামাকার চেয়ারম্যানের বাসার সামনে বিক্ষোভ করেছেন কয়েক’শ ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বেশ কয়েকবার তাদের টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও টাকা দেয়নি। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান যেন দেশ ত্যাগ করতে না পারে এজন্য সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান তাদের। দীর্ঘ সময় চেয়ারম্যানের বাসার সামনে বিক্ষোভের পর এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের শান্ত করতে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। পরে, বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা ধামাকার চেয়ারম্যানের বাসার সামনে থেকে সরে আসে।
এই ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা এবং দ্রুত সমাধান চেয়ে উদ্যোক্তরা জানান, আমাদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পাওনা ধামাকার নিকট। তাই যত দ্রুত সম্ভব ধামাকার প্রধান কোম্পানির সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ডা. মুযতবা আলি, এমডি জসিমউদ্দীন চিশতিসহ সকল পরিচালকদের দেশ ত্যাগে নিষেজ্ঞার জারি করার দাবি তাদের।
সেলাররা ঈদের আগে সকল পাওনা ফেরত চেয়ে প্রতিষ্ঠানের সকল পরিচালকদের বিরুদ্ধে সরকারের সকল দপ্তরের নিকট দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
সেলাররা ঈদের আগে সকল পাওনা ফেরত চেয়ে প্রতিষ্ঠানের সকল পরিচালকদের বিরুদ্ধে সরকারের সকল দপ্তরের নিকট দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
ই-কমার্স নিয়ন্ত্রক সংস্থা ই-ক্যাবের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত কোনো সেলার বা ভোক্তা আমাদের নিকট এমন কোনো অভিযোগ করেননি। তবে আমরা বিষয়টি দেখছি। অভিযোগ আসলে আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব।
ধামাকা শপিংয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দে সিআইডির চিঠি
এদিকে ইভ্যালিসহ ১৪টি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে সিআইডি। ইতোমধ্যে ধামাকা শপিংয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। পর্যায়ক্রমে অন্যগুলোর বিষয়েও একধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
শুক্রবার (১৬ জুলাই) সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ধামাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছি আমরা। বিভিন্ন ই-কমার্স কোম্পানি নিয়ে চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আলোচিত ই-কমার্স প্লাটফর্ম ইভ্যালির মতোই বিপুল ডিসকাউন্টে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নিয়ে সময়মতো পণ্য বা রিফান্ড পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে গতবছর ব্যবসা শুরু করা ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে।
গত ৩০ জুন ধামাকা শপিংসহ আলেশা মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, কিউকম, দালাল প্লাস, ইঅরেঞ্জ এবং বাজাজ কালেকশনের ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
৫০ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে সন্দেহ
ই-কমার্স কোম্পানি ধামাকাশপিং ডটকম গ্রাহকদের থেকে অগ্রিম নেওয়া অর্থ অন্যান্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাচার করেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া প্রমাণের ভিত্তিতে ধারণা করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “এনিয়ে তদন্ত চলছে, আমরা কিছু কিছু প্রমাণও পাচ্ছি। তবে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমি চূড়ান্তভাবে কিছু বলতে চাই না।”
তবে সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, ধামাকার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী মাসে সিআইডি বাদী হয়ে মামলা করবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “ধামাকা ইতোমধ্যে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা সরিয়েছে— তার প্রমাণ মিলেছে। কোম্পানির বিজনেস মডেলেও সমস্যা রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা তথ্য চেয়েছিলাম। তথ্যগুলো এরমধ্যে আমাদের হাতে এসেছে। এখন সেগুলো যাচাই-বাচাই চলছে।”
“ধামাকা ইতোমধ্যে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা সরিয়েছে— তার প্রমাণ মিলেছে। কোম্পানির বিজনেস মডেলেও সমস্যা রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা তথ্য চেয়েছিলাম। তথ্যগুলো এরমধ্যে আমাদের হাতে এসেছে। এখন সেগুলো যাচাই-বাচাই চলছে।”
সিআইডির তদন্তে উঠে আসে, ধামাকার মতো বেশ কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানি গ্রাহকদের থেকে নেওয়া অর্থ অন্যান্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নিয়েছে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ডাবল ভাউচার, সিগনেচার কার্ড ও বিগ বিলিয়ন রিটার্নস এবং অস্বাভাবিক মূল্য ছাড়ের ফাঁদে ফেলে হাজার হাজার গ্রাহকদের প্রতারিত করছে। এই প্রতারিত অর্থ আত্নসাৎ করতে অবৈধভাবে দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে।
ইভ্যালির মতোই গত বছরের নভেম্বরে ব্যবসা শুরু করে ধামাকা শপ। এরপর ৪০-৫০ শতাংশের মতো বড় অংকের মূল্যছাড়ের অফারের মাধ্যমে কোম্পানিটি গ্রাহকদের থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ অগ্রিম নিয়েছে।
কোম্পানির ওয়েবসাইট অনুসারে, বিভিন্ন পণ্যে তারা এখন ৪০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে। তবে বাইক ও মোটরকারের মতো দামি পণ্যে এখন মাত্র ১০ শতাংশ ছাড়ের অফার চলছে।
এদিকে অর্থ পাচার ও গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ধামাকাশপিং ডটকমের মুখ্য পরিচালনা কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম রানা টিবিএস’কে বলেন, “এ বিষয়টি আমার জানা ছিল না। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং হিসাবরক্ষণ ও আর্থিক বিভাগের প্রধান এব্যাপারে জানাতে পারবে।”
“কোন সরবরাহককে কী পরিমাণ অর্থ দিতে হবে আমি শুধু সেই চাহিদাপত্র পাঠাই। হিসাবরক্ষণ বিভাগ আমার অধীনে থাকলে আমি এব্যাপারে আপনাদের তথ্য দিতে পারতাম,” যোগ করেন তিনি।
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, “আগামী রোববার ব্যক্তিগত আয়কর ফাইল, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ব্যাংক হিসাবের বিস্তারিত তথ্য সহকারে আমাকে সিআইডি কার্যালয়ে যেতে বলা হয়েছে।”
ই-কমার্স নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ
গ্রাহকদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, দালাল প্লাসসহ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নজরদারিতে রেখেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। এছাড়া মার্চেন্ট ও গ্রাহকদের থেকে নেওয়া অগ্রিম টাকার গড়মিল পাওয়ায় সম্প্রতি ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দুদক।
সম্প্রতি ই-কমার্স নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গ্রাহক মূল্য পরিশোধ করার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরবরাহকারীর কাছে পণ্য পৌঁছে দেবে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এরপর তা ক্রেতাকে এসএমএস দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। ক্রেতা এবং বিক্রেতা একই শহরে থাকলে মূল্য পরিশোধের ৫ দিনের মধ্যে, আর ভিন্ন শহরে থাকলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে সরবরাহের সময় আরও কম রাখতে হবে।
আরও বলা হয়েছে, বিক্রেতা কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং বা অন্য যে মাধ্যমে পণ্যের অগ্রিম মূল্য ক্রেতা পরিশোধ করেছেন সেই মাধ্যমেই তা ফেরত দিতে হবে।
সিআইডির প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ কাজে সহায়তা করছে কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।
আলোচিত ১৪টি ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টির সঙ্গে ইতোমধ্যে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বন্ধ করেছে ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংক।
সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলো যখন তাদের সঙ্গে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে— তখন বুঝতে হবে, ব্যাংক তাদের সঙ্গে ব্যবসা নিরাপদ মনে করছে না। ব্যাংকগুলোর লেনদেন বন্ধের বিষয়টিও তদন্তে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৪
আপনার মতামত জানানঃ