শর্ত সাপেক্ষে য়ুরোপের বিভিন্ন কোম্পানিগুলো তাদের মুসলিম কর্মচারীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করতে পারবে। জার্মানির দুই মুসলিম নারীর করা মামলার প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার য়ুরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে।
সূত্র মতে, ওই দুই নারীকে ইসলাম অনুসারে হিজাব পরার কারণে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ওই দু’জার্মান মুসলিম নারীর একজন এক চাইল্ড কেয়ার সেন্টারের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের দেখভাল করতেন। এ চাইল্ড কেয়ার সেন্টারটি হামবুর্গ চ্যারিটেবল অ্যাসোসিয়েশন পরিচালনা করত। আরেক মুসলিম নারী মুয়েলার ড্রাগের এক চেইন স্টোরের ক্যাশিয়ার ছিলেন।
এ দুই মুসলিম নারীই তাদের চাকরির শুরুতে হিজাব পরতেন না। কিন্তু, কয়েক বছর পর মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে তারা হিজাব পরা শুরু করেন।
এ সময় ওই দু’জার্মান মুসলিম নারীকে তাদের মালিকপক্ষ বলেছে যে তারা কর্মক্ষেত্রে হিজাব পরতে পারবেন না, হিজাব পরলে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে।
তাদের আরো বলা হয়েছে হিজাব ছাড়া চাকরিতে আসেন, নয়ত অন্য চাকরিতে চলে যান। য়ুরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ আদালতের বিভিন্ন নথি অনুসারে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ রায়ে য়ুরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ আদালত বলেছে, সামজিক বিভেদ ও বিতর্ক দূর করতে আর খদ্দেরদের কাছে নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রক্ষায় (কোম্পানিগুলোর) মালিকপক্ষ কর্মক্ষেত্রে ধর্মীয় পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে।
শুধু ধর্মীয় নয় রাজনৈতিক আর দার্শনিক চিন্তা প্রকাশ করে এমন পোশাকের ক্ষেত্রে মালিক পক্ষ তাদের স্বার্থ অনুসারে পদক্ষেপ নিবে।
(কোম্পানিগুলোর) মালিকপক্ষ কর্মক্ষেত্রে তাদের নিজেদের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষার্থে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা বৈধ। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অধিকার ও স্বার্থের সমন্বয় ঘটাতে হবে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন দেশের জাতীয় আদালত তাদের রাজ্যগুলোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। বিশেষ করে দেশগুলোর ধর্মীয় স্বাধীনতা নীতি অনুসারে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
তবে আদালত এও বলেছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপের ‘প্রয়োজন’ সত্যিই আছে কিনা, চাকরিদাতা কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। আর ইউরোপী ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আদালত এ ধরনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো জাতীয় পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিতে পারে। ধর্মচর্চার সাংবিধানিক অধিকারকে সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরও উদার অবস্থানও দেখাতে পারে।
রায় দিতে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদালতকে দুটো বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়েছে। হিজাব পরায় নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে কর্মীর ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না এবং কর্তৃপক্ষের দিক থেকে ‘ধর্মীয় নিরপেক্ষতা’ বজায় রেখে ব্যবসা পরিচালনার স্বাধীনতা কতটা থাকছে।
আদালত তার সিদ্ধান্তে বলেছে, প্রতিষ্ঠানের ‘নিরপেক্ষ’ ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য যদি ‘সত্যিই প্রয়োজন হয়’, তাহলে এরকম নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায়।
কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক, দার্শনিক কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকাশ পায়- এমন দৃশ্যমান কোনো কিছু কর্মক্ষেত্রে পরার ওপরই এরকম নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে।
শিশুযত্ন কেন্দ্রের কর্মীর মামলায় আদালত জানিয়েছে, নিষেধাজ্ঞার ওই নির্দেশনা সাধারণভাবে এবং নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল। ওই দাতব্য সংস্থা একজন খ্রিস্টান কর্মীর ক্রুশও সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তারা কোনো বৈষম্য করেনি।
ইউরোনিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপীয় আদালত এটা স্পষ্ট করেছে যে, কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা যদি সব ধর্মের বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হয়, তাহলে সেখানে বৈষম্য হয়েছে বলা যাবে না।
কিন্তু কেবল হিজাব, মাথা ঢাকা স্কার্ফ বা এরকম দৃশ্যমান কোনো বস্ত্রখণ্ড বা চিহ্নের ওপর যদি নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তাহলে তাতে সরাসরি বৈষম্য করা হবে। পাশাপাশি এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা যৌক্তিক হবে না, কারণ তাতে শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাসের কারণে কোনো কোনো কর্মীকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেখা হবে।
আবার, কেনো চাকরিদাতা হয়ত ধর্মীয়, রাজনৈতিক কিংবা দার্শনিক বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটানো সব কিছু তার কর্মক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করতে চাইতে পারেন, সেটা করার আইনগত অধিকারও হয়ত তার থাকতে পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু তার ‘ইচ্ছাই’ যথেষ্ট নয়। আদালত বলেছে, ওই নিষেধাজ্ঞা তখনই দেওয়া যৌক্তিক হবে, যদি সেটা ‘সত্যিই প্রয়োজন’ হয়।
যে ধরনের পেশা বা কাজের ক্ষেত্রে সবার সামনে প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করার বৈধ তাগিদ থাকে, সেসব ক্ষেত্রে এরকম নিষেধাজ্ঞা দেয়ার যৌক্তিক কারণ ঘটতে পারে।
যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে। অভিভাবকরা চাইতে পারেন যে তার সন্তানকে এমন কেউ পড়াক, যার ধর্মীয় বিশ্বাস শিক্ষার্থীর সামনে দৃশ্যমান হবে না।
ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস বলেছে, চাকরিদাতা কর্তৃপক্ষকে এটাও প্রমাণ করতে হবে যে, ওই ধরনের নিষেধাজ্ঞা না দিলে তা তার প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির কারণ হবে।
এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিষয়গুলো যৌক্তিক হচ্ছে কি না, তা জাতীয় নীতির ভিত্তিতে বিবেচনা করবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো।
বহু বছর ধরেই য়ুরোপে হিজাব নিয়ে বিতর্ক চলছে। এর আগে ২০১৭ সালে লুক্সেমবার্গের য়ুরোপীয় ইউনিয়নের আদালত থেকে বলা হয়েছে, শর্ত সাপেক্ষে য়ুরোপের বিভিন্ন কোম্পানিগুলো তাদের কর্মচারীদের হিজাব পরা বা অন্য ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে পারবে। তখন বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা এমন সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছিল।
কয়েক বছর ধরে য়ুরোপে একাধিক আইএস হামলার পরে বোরকার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বেশ কিছু দেশ। এর আগেই ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, বুলগেরিয়া, বেলজিয়াম ও ল্যাটভিয়া— য়ুরোপের এই সাতটি দেশে বোরখা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পাশাপাশি কিছু মুসলিম দেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি আছে বিশেষ এই পোশাকটির বিরুদ্ধে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১১২০
আপনার মতামত জানানঃ