অতিমাত্রায় করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে যাবার পর থেকে। হাসপাতালে রোগীর ভিড় সামাল দেয়া যাচ্ছে না। রংপুর বিভাগের দিনাজপুর জেলাটি ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ার দরুণ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কবলে পড়েছে ভালোভাবেই।
দিনাজপুরের করোনা ইউনিটে ১৬৩ জন রোগী আছেন শয্যায়, মেঝেতে ঠাঁই হয়েছে ৩২ জনের। এই ১৯৫ জন করোনা রোগী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অল্পসংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স। এদিকে করোনার চিকিৎসা নিতে এসে গরিব রোগীরা পড়েছেন সংকটে। অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
রেড জোনে থাকা করোনা রোগীর পেছনে ব্যয় আকাশচুম্বী
হাসপাতালের রেড জোনে ভর্তি আছেন সুলতানা বেগম (৩৮)। জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত ২৭ জুন ভর্তি হন তিনি। সোমবার থেকে কিছুটা সুস্থতা বোধ করছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত তার চিকিৎসায় আনুষঙ্গিক ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে ৫২ হাজার টাকার ওষুধ। স্ত্রীকে সুস্থ করতে পুরো টাকাই ধার করেছেন স্বামী জহুরুল ইসলাম। পেশায় তিনি একজন বর্গাচাষি।
জহুরুলের মতো নিম্ন আয়ের অনেকেই আছেন যারা স্বজনদের চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত প্রতিজনের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধসহ মোট চিকিৎসা ব্যয় হচ্ছে ৪০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। গড়ে ১৫-২০ দিন চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে মারাও যাচ্ছেন কেউ কেউ। রোগীর স্বজনেরা বেশির ভাগ ওষুধ কিনছেন বাইরে থেকে।
হাসপাতালের করোনা ইউনিটের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক কামাল হোসেন জানান, যারা করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের ইয়েলো জোনে রেখে সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশির ওষুধ দেওয়া হয়। নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ হলে এবং শ্বাসকষ্ট থাকলে রেড জোনে রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে রেমডিসিভির ইনজেকশন, ভিটামিন ডিসহ ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়।
পর্যাপ্ত পরিমান নার্সের অভাব
গতকাল (১৫ জুলাই) বুধবার সকালে দেখা যায়, প্যাথলজি বিভাগের করিডরে রোগীর স্বজনদের ভিড় কম। অন্যান্য কক্ষে ভিড় বেশি। প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে তিন-চারজন করে স্বজন। কর্তব্যরত একজন নার্স জানান, আয়া ও ওয়ার্ড বয় মিলে চারজন দায়িত্ব পালন করছেন এখানে। তিনি বলেন, রোগীর চাপ অনুযায়ী সর্বনিম্ন আটজন আয়া ও ওয়ার্ড বয় দরকার। ওয়ার্ড বয়-সংকটে অনেক সময় রোগীর স্বজনেরা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছোটাছুটি করছেন।
করিডরের মাঝামাঝি জায়গায় একটি ট্রলিতে বিভিন্ন ওষুধ ও স্যালাইন নিয়ে আছেন ছয়জন নার্স। কাউন্টারে আছেন আরও কয়েকজন। কারও সঙ্গে কথা বলার ফুরসত নেই তাদের। রোগীর স্বজনেরা ঘিরে আছেন চারদিক থেকে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখে ওষুধ মিলিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। কেউ শুনছেন স্বজনের অভিযোগ।
এদিকে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আবু রেজা মো. মাহমুদুল হক বলেন, করোনা ইউনিটে আরও অন্তত ৩৫ জন চিকিৎসক দরকার। নার্স দরকার ৪০ জন। ইতিমধ্যে ৩০ জনের বেশি নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এসব কারণে চিকিৎসাসেবা কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। তবে চাহিদা দেওয়া হয়েছে। জনবলসংকট কেটে গেলে রোগীদের আর কোনো অভিযোগ থাকবে না।
হাসপাতালে ছন্নছাড়া অবস্থা, নিয়ম নীতি মানছেন না রোগীর স্বজনরাও
প্যাথলজির করিডরে ১৬টি শয্যা। এর মধ্যে মেঝেতে বিছানা আছে ১০টি। নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো অবস্থায় আছেন জামিলা বেগম। ঠাকুরগাঁও থেকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছেন গত রোববার। এখনও শয্যা পাননি। ওই ইউনিটেরই মেঝেতে আছেন আবদুস সোবহান। তার এক স্বজন বলেন, ‘বেডে শুতে চায় না, ভয় করে। তাই মেঝেতে রেখেছি।’
ফ্লু কর্নার-১-এর ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বে আছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স রেশমা আক্তার। তিনি জানান, এই ইউনিটের ৪২ জন রোগী সেন্ট্রাল অক্সিজেনের আওতায় আছেন। অন্যদের সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। তারপরও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনেরা কথা শুনতে চান না। স্বাস্থ্যবিধি মানতে চান না। দুদিন আগে এক রোগীর স্বজন আমাদের অবহিত না করে একাই পাঁচটি সিলিন্ডার নিয়ে রোগীর বেডের নিচে রেখেছেন।’
বর্তমানে হাসপাতালে স্যালাইন, এজিথ্রোমাইসিন, মেরোপেনাল, সিপ্রোক্সিন, প্যারাসিটামল এবং হিস্টামিন জাতীয় ওষুধের সরবরাহ আছে। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ছয়টি রেমডিসিভির ইনজেকশনের ডোজ দেওয়া হয়। দুই মাস আগে ৩০টি ইনজেকশন পেয়েছিলো দিনাজপুরের করোনা চিকিৎসাসেবা দেয়া হাসপাতালটি। তারপর থেকে এটার সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এ কারণে রোগীদের ইনজেকশনটি বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে বলে জানান হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক।
নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য করোনার চিকিৎসা করানো প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি চলে গেছে এর ব্যয়বহুল খরচের কারণে। যেসব প্রয়োজনীয় ইনজেকশনের সরকারিভাবে সরবারহ হবার কথা, তা না থাকায় এমন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। নিম্নআয়ের মানুষদের কথা চিন্তা করে, সরকারী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রগুলো হাসপাতালকে সরবারহ করা প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ