ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মুসলিম নারীদের অপদস্ত ও হেনস্থা করার জন্য তাদের ছবিসহ ‘অ্যাপে’ বিজ্ঞাপন দিয়ে নিলামে তুলা হচ্ছে। এদিকে মুসলিমদের মারধর করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো, হেনস্থার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়া এখন রুটিনে পরিণত হয়েছে। খবর বিবিসি
অনলাইনে নারী বিক্রির বিজ্ঞাপন
নারীদের পণ্য মনে করা মানসিকতার পুরুষের সংখ্যা বিশ্বে নেহাত কম নয়। তবে ভারতে এবার সেই মানসিকতার এক বাস্তবিক প্রয়োগও দেখা গেল। কয়েক ডজন মুসলিম যুবতী ও নারীর সম্মতি না নিয়েই তাদের ছবি ব্যবহার করে অনলাইনে তাদেরকে বিক্রি করে দেয়ার বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের হয়রানির নতুন ও বিস্ময়কর এ পন্থার খবর প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
জানা গেছে, সালি ডিলস’ নামের একটি অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে বিভিন্ন নারীর ছবিসহ প্রোফাইল তৈরি ও প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে নারীদের বিশেষায়িত করা হয়েছে ‘ডিলস অফ দ্য ডে’ বলে।
গত সপ্তাহে ভারতের অর্ধশত মুসলিম নারী জানতে পারেন যে অনলাইনে বিক্রির জন্য পণ্য হিসেবে তাদের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন বাণিজ্যিক একটি বিমান সংস্থার একজন পাইলটও। এ তথ্য ফাঁস হওয়ার পর তাদের শিরদাড়া বেয়ে নামছে হিম আতঙ্ক। তবে অভিযোগ করার পর ওই অ্যাপ ও তাদের ওয়েবসাইট সাসপেন্ড করা হয়েছে। ঘটনার শিকার নারীরা ন্যায়বিচার দাবি করেছেন। এ নিয়ে অনলাইন বিবিসিতে রিপোর্ট লিখেছেন সাংবাদিক গীতা পান্ডে।
তিনি লিখেছেন, কয়েক ডজন নারী নিজেদেরকে এভাবে অনলাইনে আবিষ্কার করেন, যেখানে তাদেরকে বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর মধ্যে বাণিজ্যিক একজন পাইলট মিস হেনা খানের নাম রয়েছে। তিনি বলেছেন, একজন বন্ধু তাকে বিষয়টি অবহিত করেন টুইটে। ‘সালি ডিলস’ নামের একটি অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট ব্যবহার করে এসব করা হয়। এসব অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে নারীদের ছবি ব্যবহার করে তাদের জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা হয় এবং তা প্রকাশ করা হয়। এসব নারীকে বর্ণনা করা হয় ‘ডিলস অব দ্য ডে’ হিসেবে।
এই অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ‘সালি’ কিনতে প্রস্তাব দেয়া হয়। ‘সালি’ শব্দটি মুসলিম নারীদের অবমাননা করতে অশ্লীলভাবে ব্যবহার করে ডানপন্থি হিন্দুরা। তবে ওই অ্যাপে বাস্তবে কোনো অকশন বা নিলাম হয়নি। এর উদ্দেশ্য শুধু অবমাননা এবং অপদস্ত করা।
মিস হেনা খান বলেন, তাকে টার্গেট করা হয়েছে শুধু তার ধর্মের কারণে। তার ভাষায়, আমি একজন মুসলিম নারী। এটা তারা জানতে পেরেছে। তারা আমাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চায়।
‘সালি ডিলস’ নামের একটি অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে বিভিন্ন নারীর ছবিসহ প্রোফাইল তৈরি ও প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে নারীদের বিশেষায়িত করা হয়েছে ‘ডিলস অফ দ্য ডে’ বলে।
ওপেন সোর্স অ্যাপটি চলছিল ওয়েব প্ল্যাটফর্ম গিটহাবের মাধ্যমে। অভিযোগ পেয়েই দ্রুত সালি ডিলস বন্ধ করে দিয়েছে গিটহাব।
বিবৃতিতে গিটহাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘এ ধরনের কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি আমরা। আমাদের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছি।’
কিন্তু অপমানজনক এই অভিজ্ঞতা গেঁড়ে বসেছে ভুক্তভোগী নারীদের মনে। অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকে ভবিষ্যতে এমন আরও হয়রানির শিকার হতে পারেন বলে উদ্বিগ্ন।
অ্যাপটিতে যেসব নারীকে ‘বিক্রি’র তালিকায় তোলা হয়েছিল, তারা সবাই মুসলিম এবং অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার। এদের প্রায় সবাই পেশায় সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, শিল্পী বা গবেষক।
বেশ কয়েকজন নারী অবশ্য উল্টো প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছেন। সালি ডিলসে তাদের তথ্য প্রকাশ করে দেয়ার ঘটনায় জড়িতদের ‘বিকৃতমস্তিষ্ক’ আখ্যা দিয়েছেন তারা; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছেন এই ‘বিকৃতমস্তিষ্ক’দের বিরুদ্ধে লড়াই করার।
হোয়াটসঅ্যাপে এরই মধ্যে একটি গ্রুপ খুলেছেন তারা এবং ঐক্যবদ্ধভাবে অভিযোগ করেছেন পুলিশের কাছে। এদেরই একজন হানা খান।
এই হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন সুপরিচিত নাগরিক, অধিকারকর্মী ও নেতারা। পুলিশ এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছে। তবে ওই অ্যাপের নেপথ্যে কে বা কারা আছে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। যারা এই অ্যাপ তৈরি করেছে, তারা নিজেদের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করেছে। কিন্তু বিরোধী কংগ্রেস দলের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়ক সমন্বয়ক হাসিবা আমিন এর জন্য বেশ কিছু অ্যাকাউন্টকে দায়ী করেছেন। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত মুসলিমদের, বিশেষ করে মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হয়। একই সঙ্গে ওইসব অ্যাকাউন্ট থেকে ডানপন্থি রাজনীতিতে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
মিসেস আমিন বলেন, এটাই প্রথম এমন নয়। মুসলিম নারীদের এভাবেই টার্গেট করা হয়। ১৩ই মে মুসলিমরা যখন পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন, তখন ইউটিউবে একটি চ্যানেল চালু করা হয়। এর নাম দেয়া হয় ‘ইদ স্পেশাল’। এটি ভারত ও পাকিস্তানি মুসলিম নারীদের সরাসরি ‘নিলামে’ বিক্রির একটি প্লাটফর্ম বলে প্রচারণা চালানো হয়।
মিস হেনা খান বলেন, এতে নারীদের শারীরিক গঠনের ওপর ভিত্তি করে তারা প্রতিজন নারীর মূল্য নির্ধারণ করে ৫ রুপি থেকে ১০ রুপি (৬৭ সেন্ট, ৪৮ সেন্ট)। এমনকি তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের বর্ণনা দেয়া হয়। হুমকি দেয়া হয় ধর্ষণের।
গত সপ্তাহে সারা বিশ্বের দুই শতাধিক অভিনয়শিল্পী, সুরকার, সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তা ফেসবুক, গুগল, টিকটক ও টুইটারের প্রধান নির্বাহীদের কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন। নারীদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানানো হয় চিঠিটিতে।
তারা লেখেন, ‘একবিংশ শতাব্দীতে যোগাযোগের কেন্দ্রই ইন্টারনেট। এখানেই এখন বিতর্ক হয়, যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি হয়, পণ্য কেনাবেচা হয় এবং মানুষের ভাবমূর্তিও এই মঞ্চেই তৈরি হয়।
‘কিন্তু অনলাইনে যে হারে হয়রানি বেড়েছে, এর অর্থ হলো, এই ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রে নারীরা নিরাপদ নেই।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারতে অনলাইনে হয়রানিবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে গত বছর।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, নারীরা যত বেশি সোচ্চার, তারা তত বেশি হয়রানির শিকার। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের মতোই ভারতেও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও দলিত বর্ণের নারীরা হয়রানির সহজ লক্ষ্যবস্তু।
অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার সাবেক মুখপাত্র ও লেখক নাজিয়া ইরাম বলেন, ‘ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা মুসলিম নারীর সংখ্যা হাতে গোণা। তারাও দিনের পর দিন হয়রানির শিকার হয়ে আসছেন।
‘এসব সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত হামলার লক্ষ্য হলো শিক্ষিত মুসলিম নারীদের মতপ্রকাশে বাধা দেয়া এবং মুসলিমবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তাদের কথা না বলতে দেয়া। তাদেরকে লজ্জা দিয়ে মুখ বন্ধ করার এবং সমাজে তাদের অবস্থান নড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।
কংগ্রেস নেত্রী হাসিবা আমিন বলেন, ‘যারা এসব হয়রানির হোতা, তারা নির্ভয়েই এসব অপকর্ম করে। কারণ তারা জানে যে তাদের কোনো বিচার হবে না, তারা পার পেয়ে যাবে।’
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কথাও উল্লেখ করেন হাসিবা, যেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অরাজকতা উসকে দিয়েছে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির সমর্থকরা।
উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন মুসলিম হত্যার অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আট হিন্দুকে ফুলের মালা দিয়ে এক মন্ত্রীর শুভেচ্ছা জানানোর খবর। গত বছর প্রকাশ্য জনসমাবেশে মুসলিমদের গুলি করার কথা বলা ভারতের নতুন তথ্যমন্ত্রীর একটি ভাইরাল ভিডিওর কথাও জানান হাসিবা।
এমন পরিস্থিতিতে সালি ডিলস অ্যাপে যে নারীদের পরিচয় ও তথ্য চুরি করে প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন ও দীর্ঘ লড়াইয়ের বিষয়। কিন্তু ন্যায়বিচার পেতে সর্বোচ্চ শক্তিতে লড়াই করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা।
হাসিবা বলেন, ‘নারীদের অনলাইনে নিলামে তোলার ঘটনায় জড়িতদের যদি পুলিশ চিহ্নিত না করে, আমি আদালতে যাব। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাব।’
জয় শ্রীরাম’ বলানো, হেনস্থার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়া
জনসংখ্যার বিচারে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন আগামী বছরের শুরুতেই।
ভোটের আগে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকেই খবর আসছে, পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ওপর সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে এবং মারধর করে তাদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতেও বাধ্য করা হচ্ছে।এই ধরনের ঘটনাগুলোর ভিডিও করে তা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও— যাতে মুসলিম সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ওপর সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে এবং মারধর করে তাদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতেও বাধ্য করা হচ্ছে।এই ধরনের ঘটনাগুলোর ভিডিও করে তা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও— যাতে মুসলিম সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সমাজকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, ভোটের আগে রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের লক্ষ্যেই খু্ব পরিকল্পনা করে এই কাণ্ডগুলো ঘটানো হচ্ছে— যদিও উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি এই অভিযোগ মানতে নারাজ।
কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথের আমলে উত্তরপ্রদেশে এই ধরনের ঘটনা এখন এতটাই ডালভাত হয়ে গেছে যে এখন মিডিয়াতেও এসব খবর ঠাঁই পায় না বললেই চলে।
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যটিতে বিধানসভা ভোট মাত্র ছ-সাত মাস পরেই।
তার ঠিক আগে সেই রাজ্যে মুসলিম নির্যাতন যেন একটা নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী চলছে, একটা প্যাটার্ন অনুসরণ করছে— বিবিসিকে বলছিলেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সাবেক ছাত্রনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট আফরিন ফতিমা।
আফরিন ফতিমা বলছিলেন, “এ রাজ্যে মুসলিমদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে— আর পুরোটাই করা হচ্ছে পরিকল্পিত ছকে।”
“গবেষণা বলে, যে কোনও দাঙ্গার পরেই মুসলিমরা কিন্তু মিশ্র বসতির এলাকা ছেড়ে গিয়ে নিজেদের ঘেটো-তে গিয়ে বাস করতে চায়। এখানেও ভোটের আগে ভয় দেখিয়ে ঠিক সেভাবেই মুসলিমদের কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে।”
“রুটিরুজির প্রয়োজনে তাদেরও বাইরে বেরোতেই হয় কিন্তু উত্তরপ্রদেশে প্রতিটি মুসলিম নারী-পুরুষ জানেন প্রতিদিন বাড়ির বাইরে পা ফেলেই তারা বিরাট একটা ঝুঁকি নিচ্ছেন!”
যতই অবিশ্বাস্য শোনাক— নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে বিশেষ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বাস্তবতা কিন্তু এটাই।
বয়স বারো হোক বা বাহাত্তর, মুসলিমদের পরিকল্পিতভাবে মারধর করা হচ্ছে, জোর করে বলানো হচ্ছে জয় শ্রীরাম।
গোটা ঘটনার ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে— যেগুলো দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ছে জাঠদের মহাপঞ্চায়েত।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৩৫২
আপনার মতামত জানানঃ