যদিও ক্ষুধাকে মহামারি হিসাবে ঘোষণা করা হয়নি তবুও মানুষের প্রাণ সংহারের দিক থেকে ঘোষিত ও প্রচলিত মহামারি করোনার চেয়ে দেড়গুণ বেশি। করোনা মহামারিতে প্রতি মিনিটে মানুষ মারা যাচ্ছে ৭ জন আর ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে ১১ জন। শুক্রবার(৯ জুলাই) প্রকাশিত ‘দ্য হাঙ্গার ভাইরাস মাল্টিপ্লাইস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম।খবর এএফপির।
ওই প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, বিশ্বে করোনায় রোজ যত মানুষ মারা যাচ্ছে, এর চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে ক্ষুধায়। করোনায় যেখানে মিনিটে ৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে সেখানে ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে ১১ জন।
অক্সফাম বলেছে, সহিংসতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। করোনাভাইরাসের মহামারি এই দরিদ্র মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরও প্রভাব ফেলেছে। করোনাভাইরাসের মহামারিতে প্রতি মিনিটে বিশ্বজুড়ে মারা যাচ্ছেন সাতজন। আর ক্ষুধার তাড়নায় মারা যাচ্ছে প্রতি মিনিটে ১১ জন।
অক্সফাম বলেছে, বিশ্বজুড়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালে ‘দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থার’ মধ্যে যে পরিমাণ মানুষ বসবাস করেছেন, ২০২০ সালে সেই সংখ্যা ছয় গুণ বেড়েছে।
গত বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অক্সফাম সতর্ক করে বলেছিল, করোনার প্রাদুর্ভাব বিশ্বের ক্ষুধা সংকটকে আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। করোনার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষুধায় প্রতিদিন ১২ হাজার মানুষ মারা যেতে পারে।
অক্সফামের আমেরিকার আঞ্চলিক প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী আবি ম্যাক্সম্যান বলছেন, ‘পরিসংখ্যান বিস্ময়কর, তবে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে এই পরিসংখ্যান তৈরি হয়েছে অকল্পনীয় দুর্ভোগের মুখোমুখি ব্যক্তিদের নিয়ে। সংখ্যাটা একজন হলেও অনেক।’
সহিংসতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। করোনাভাইরাসের মহামারি এই দরিদ্র মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরও প্রভাব ফেলেছে। করোনাভাইরাসের মহামারিতে প্রতি মিনিটে বিশ্বজুড়ে মারা যাচ্ছেন সাতজন। আর ক্ষুধার তাড়নায় মারা যাচ্ছে প্রতি মিনিটে ১১ জন।
দাতব্য সংস্থাটি বলছে, বিশ্বজুড়ে ১৫৫ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার চেয়ে খারাপ বা আরও খারাপ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ২০ মিলিয়ন বেশি। এর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ খেতে পারে না কারণ তাদের দেশে সামরিক সংঘাত চলছে।
অক্সফামের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের মহামারির শুরুতেই বিশ্বজুড়ে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের মানুষদের পক্ষ থেকে এক পরিষ্কার ও জরুরি বার্তা দেওয়া হয়েছে, ‘করোনার আগেই ক্ষুধা আমাদের মেরে ফেলবে।’ বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে দুর্ভিক্ষে।
অক্সফাম জানিয়েছে, ইয়েমেন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, ভেনেজুয়েলায় ও সিরিয়ায় মহামারির আগে থেকেই খাদ্যসংকট ছিল। করোনার মহামারি ও এর কারণে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তার ফলে খাদ্যসংকট আরও বেড়েছে।
খাদ্য সংকট ২০২১ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী জুনের মাঝামাঝি সময়ে ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কার, দক্ষিণ সুদান আর ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে তীব্র পর্যায়ে পড়া মানুষের সংখ্যা ৫ লাখ ২১ হাজার ৮১৪। গত বছরের ৮৪ হাজার ৫০০ এর চেয়ে যা ৫০০ শতাংশ বেশি।
মহামারির প্রাদুর্ভাব ও এর ফলে সৃষ্ঠ অর্থনৈতিক পরিণতির কারণে ইয়েমেন, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (ডিআরসি), আফগানিস্তান এবং ভেনেজুয়েলাসহ এমন অনেক দেশে বিদ্যমান খাদ্য সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
অক্সফাম বলছে, করোনার কারণে মানুষ কাজ হারিয়েছে। এ ছাড়া খাদ্যের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিকভাবে খাবারের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। বিগত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যবৃদ্ধি এটি।
আন্তর্জাতিক এই দাতব্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুসারে, বিশ্বজুড়ে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ ‘দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থার’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া চরম ক্ষুধায় রয়েছে সাড়ে ১৫ কোটি মানুষ। এই সাড়ে ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে প্রতি তিনজনে দুজনের বসবাস সহিংস ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে।
অক্সফাম বলছে, এর তিনটি প্রধান কারণ হলো কোভিড-১৯, জলবায়ু সংকট এবং সংঘাত। মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে যুদ্ধগুলো ক্ষুধার একক বৃহত্তম চালক ছিল যা ২৩টি দেশের প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষকে খাদ্য সংকটের আরও খারাপ স্তরে ঠেলে দিয়েছে।
আবি ম্যাক্সম্যান বলছেন, ‘আবহাওয়া বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক ধাক্কায় ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষের জন্য শেষ আঘাত হিসেবে দেখা দিয়েছে মহামারির প্রকোপ ঠেকাতে লড়াইয়ের পরিবর্তে যুদ্ধরত পক্ষগুলো একে অপরের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়া।’
এর আগে বিশ্বের চার কোটির বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। সংস্থাটি জানায়, মৌলিক খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করেছে।
ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলি জানান, ৫০ লাখ মানুষ এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষে দিন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, চারটি দেশের পরিস্থিতির খবর আমরা জানি, যেখানে দুর্ভিক্ষ চলছে। আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের চার কোটি ১০ লাখ মানুষের দরজায় দুর্ভিক্ষ কড়া নাড়ছে। আমাদের তহবিল দরকার এবং তা এখনই।
কয়েক দশক ধরে বিশ্বে ক্ষুধা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ২০১৬ থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করে মূলত সংঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে। ডব্লিউএফপির হিসাবে, ২০১৯ সালে দুই কোটি ৭০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে কভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
জাতিসংঘের হিসাবে, এ বছরের মে মাসে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়। বিশেষ করে খাদ্যশস্য, তেলবীজ, দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস ও চিনির মতো মৌলিক খাবারের দাম গত বছরের চেয়ে এ মাসে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। সংস্থাটির হিসাবে, গত এক বছরে ভুট্টার দাম আগের বছরের তুলনায় ৯০ শতাংশ আর গমের দাম ৩০ ভাগ বেড়েছে।
লেবানন, নাইজেরিয়া, সুদান, ভেনেজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ের মতো দেশে অস্বাভাবিক মূল্যস্ম্ফীতি এ পরিস্থিতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে এবং পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে সেসব অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এ বছর ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কার, দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেন, নাইজেরিয়া ও বারকিনা ফাসোর কিছু কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত বছর নোবেল পুরস্কার পাওয়া ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর ৯ শতাংশ বা প্রায় ৬৯ কোটি মানুষ প্রতি রাতে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১১০
আপনার মতামত জানানঃ