মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কই ইসরায়েলকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। ১৯৪৯ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া তুরস্ক দীর্ঘ ছয় দশক দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে। এরদোগান ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের উষ্ণ ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এরপর কেন এই বৈরিতা। ফিলিস্তিনের প্রতি ইসরায়েলের অমানবিক নীতিই কি এর একমাত্র কারণ। নাকি অন্য কিছু!
দেশ দুটির ৬০ বছরের সুসম্পর্কে তিক্ততা শুরু হয় বছর দশেক আগে। নথি ঘেঁটে দেখায় যায়, তুরস্কের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক ছিন্ন হবার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ২০১০ সালে গাজা অভিমুখে তুরস্কের ত্রানবাহি ‘মাভি মারমারা’ জাহাজে ইসরায়েলি সৈন্যদের হামলা। এই হামলায় তুরস্কের ১০ জন নাগরিক নিহত হবার পর দু’দেশ সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। এই হামলার পর ইসরাইলের সাথে তুরস্কের কূটনীতিক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এরপর ২০১৬ সালে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়। দু’দেশ একটি চুক্তিতে আসে। এই চুক্তিতে ইসরায়েল তুরস্ককে ২০ মিলিয়ন ডালার ক্ষতিপূরণ দেয়। এছাড়া তুরস্ক যাতে গাজায় সাহায্য পাঠাতে পারে এবং ফিলিস্তিনের ভেতরে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করতে পারে ইসরায়েল সে অনুমতিও দেয়। সে সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন, এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
এর আগে ২০০২ সালে এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে দেশ দুটি বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ও পর্যটন খাতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল। ক্ষমতায় আসার পর এরদোগান ২০০৫ সালে ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব অবসানে শান্তির বার্তা নিয়ে ইসরায়েল সফর করেছিলেন। ২০০৮-০৯ সালে গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ হিসেবে অভিহিতও করেন।
এরপর ২০১৮ সালে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এবং এর প্রতিবাদে আন্দোলনরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল হামলা চালালে প্রতিবাদ হিসেবে ইসরায়েল থেকে রাষ্ট্রদূত সরিয়ে নেয় তুরস্ক।
তবে এই মুহূর্তে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বেশ নাজুক সময় পার করছে। নেতানিয়াহুর বিদায়, গদিতে নাফতালি বেনেটের স্থির হওয়া, জোট সরকারের ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের পরস্পরবিরোধী আটটি দলকে সরকার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এক ছাতার তলায় রাখা— হাড়ভাঙা না হলেও মাথাভাঙা পরিশ্রমের কাজ ঠিকই।
শুধু নেতানিয়াহুকে গদি থেকে সরানোর জন্য ইসরায়েলের পরস্পরবিরোধী মতের আটটি দল জোট করে সরকার গঠন করেছে। তার মানে এই নয় যে নেতানিয়াহুর পররাষ্ট্রনীতিকে তারা পুরোপুরি উল্টেপাল্টে দেবে। তবে তার কিছু কাজকে অবশ্যই বিভিন্ন শরিক দল বাতিল করতে চাইবে।
আর এই কাজগুলো দক্ষতার সাথে করতে ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের সরকার এখন দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করছে। নেতানিয়াহুর রেখে যাওয়া পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করে তারা নতুন একটি কর্মকৌশল তৈরি করতে চাইছে। আর এই কর্মকৌশলের দাবার বর্ডে তুরস্ক যেন বিপক্ষ দলের মন্ত্রী। বাগে আনতে তাই বেনেটকে ছক কষতে হবে সুকৌশলে।
আর এরই মধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে ইসরায়েলের নতুন সরকার তুরস্কের সঙ্গে তাদের সাবেক সুসম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না, এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে।
পূর্বাঞ্চলীয় ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার দেশগুলোতে নিজের মিত্রসংখ্যা বাড়াতে কায়রোভিত্তিক পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাস ফোরামভুক্ত দেশগুলোর (গ্রিস, মিসর, সাইপ্রাস, ইতালি, জর্ডান ও ফিলিস্তিন) সঙ্গে ইসরায়েল সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। তবে তুরস্ক এ অঞ্চলের দেশ হওয়া সত্ত্বেও, তুরস্ককে কখনো এ জোটে যুক্ত হওয়ার জন্য ডাকা হয়নি।
এদিকে, ইসরায়েলের সরকারের শরিক দলগুলোর মধ্যে কোনো কোনো দল চায় তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েল আবার সুসম্পর্ক গড়ে তুলুক। দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক আদান–প্রদান হোক। এটি হলে মুসলিম বিশ্বে ইসরায়েলের স্বীকৃতি পাওয়া সহজ হবে। ইসরায়েলের সরকারের শরিক দল ইসরায়েলি-আরব রা’আম পার্টির অন্তর্ভুক্তিকে অনেকে ইসরায়েলের প্রতি তুরস্কের ক্ষমতাসীন একেপির বন্ধুত্বের পথ প্রশস্ত হওয়া হিসেবে দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞই।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তুরস্ক মিসর ও ফিলিস্তিনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সংঘাতপূর্ণ নৌ সীমায় মিসর ও ফিলিস্তিনিদের চলাচলে শিথিল নীতি অবলম্বন করতে চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে। হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া তুরস্কের এ প্রস্তাবকে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র-স্বীকৃতির একটি বড় ধাপ বিবেচনা করে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
২০১৯ সালে তুরস্ক লিবিয়ার ত্রিপোলিভিত্তিক জাতীয় ঐক্যের সরকারের সঙ্গেও একই ধরনের চুক্তি করেছিল। এ ধরনের চুক্তি সরাসরি ইসরায়েলের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তুরস্কের প্রভাব যাতে না বাড়ে, সে জন্য ইসরায়েল সব সময়ই চেষ্টা করে আসছে। বিশেষ করে হামাসের সঙ্গে তুরস্কের ঘনিষ্ঠতাকে ইসরায়েল ভালোভাবে নিতে পারেনি।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেছেন, ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নির্ভর করছে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বেআইনি আচরণ বন্ধ করবে কি না, তার ওপর। এদিকে, তুরস্ক যেহেতু হামাসকে সমর্থন করে, সেহেতু তার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সহজ হবে না। ১৯৪৯ সাল থেকে তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও তুরস্কে এরদোগান সরকার ক্ষমতা গঠনের পর থেকে সেই সম্পর্ক এখন বরফের মতো শীতল অবস্থায় চলে গেছে।
তবে গত বছরের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইসরায়েলের ফিলিস্তিন নীতির কঠোর সমালোচনা করলেও দেশটির সঙ্গে তুরস্ক আরও ভালো সম্পর্ক চায় বলে মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোগান। তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে গোয়েন্দা আলোচনা আবারও শুরু করতে তার সায় ছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ