সংঘাতে কবলিত রাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সকল সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল স্কট মিলার। মঙ্গলবার (২৯ জুন) তিনি এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
সম্প্রতি আফগানিস্তানে হামলা বাড়িয়েছে তালিবান। গত কয়েক দিনে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি প্রায় ১০০ জেলা কেন্দ্র দখল করেছে। এসব হামলায় অনেক বেসামরিক নাগরিক নিহত, আহত ও কয়েক হাজার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
মার্কিন জেনারেল বলেন, যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এটি বিশ্বের জন্য উদ্বেগের হতে পারে।
জেনারেল মিলার জানান, সেনা প্রত্যাহার এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে শিগগিরই তিনি তার কমান্ডের ইতি ঘটাবেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর তার কমান্ড শুরু হয়েছিল। তিনি বলেন, সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে ভালোভাবে সবকিছু এগিয়ে যাচ্ছে।
গত মে মাস থেকে মার্কিন সেনাসহ আফগানিস্তানে অবস্থানরত সকল বিদেশি সেনাকে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরপরই আফগান সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তালিবানের যুদ্ধ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশটির সশস্ত্র ওই গোষ্ঠীটি একের পর এক এলাকা সেনাবাহিনীর কাছ থেকে দখল করে নিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতেই আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের কাজ চলছে এবং আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের পর দেশটিতে আর কোনো বিদেশি সেনা থাকবে না।
সংবাদ সম্মেলনে জেনারেল মিলার বলেন, ‘বিদেশি সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর যদি দেশটির রাজনৈতিক পক্ষগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে, তাহলে বড় ধরনের হুমকি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।’
এর আগে তালেবান যোদ্ধারা বিভিন্ন জেলার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মাধ্যমে রাজধানী কাবুল ঘিরে ফেলছে বলে সতর্ক করে জাতিসংঘ।
একই ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করে জেনারেল মিলার বলেন, ‘আফগানিস্তানের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো নয়। যা যা ঘটছে এরই মধ্যে সেগুলো মাথায় রাখলে এখনই চোখের সামনে গৃহযুদ্ধ দেখতে পাচ্ছি। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। এটা সারা বিশ্বের জন্যই উদ্বেগের বিষয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া শান্তিচুক্তি তালিবান লঙ্ঘন করছে এবং সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগান সেনারা আকাশপথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা পাচ্ছে না বলেই তালিবানের দৌরাত্ম্য বাড়ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিমান হামলার শঙ্কাও উড়িয়ে দেননি মিলার। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না বিমান হামলা চালাতে। কিন্তু বিমান হামলা বন্ধে তালিবানকে সহিংসতার পথ ছাড়তে হবে।’
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারসহ কয়েকটি স্থানে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, ক্ষমতাচ্যুত করে তালিবানকে। নাইন ইলেভেনের হামলার হোতা নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন ও অন্যান্য নেতাদের আশ্রয় দিয়েছিল তালিবান।
বিদেশি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম এই যুদ্ধ শুরুর ২০ বছর পর আফগানিস্তান ছাড়ছে দেশটির সেনারা।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আফগানিস্তান আর পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে জিহাদিদের ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হবে না বলে নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারপরই শুরু হয়েছে সেনা প্রত্যাহার।
আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিরও দাবি, নিজ দেশের সেনাবাহিনী জঙ্গিবাদ রুখতে সক্ষম।
কিন্তু দেশটি আবারও তালিবানের ঘাঁটি হয়ে উঠবে বলে উদ্বিগ্ন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় আফগানিস্তানকে স্থিতিশীল রাখতে সেনা প্রত্যাহারের পরও যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা রাখবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন বাইডেন। কিন্তু সে সহায়তা সামরিক হবে না।
তালিবান সম্প্রতি হামলা জোরদার করলেও আফগানিস্তান ত্যাগী যু্ক্তরাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সেনাদের ওপর কোনও আঘাত আনছে না। তারা আফগান নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছে। এতে মারা পড়ছেন বেসামরিক নাগরিকরা।
গত সপ্তাহে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, কূটনীতিকদের নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৬৫০ জন সেনা আফগানিস্তানে থেকে যেতে পারেন।
আফগানিস্তান থেকে জার্মান সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সম্পূর্ণরুপে প্রত্যাহার করে নিয়েছে জার্মানি। মঙ্গলবার (২৯ জুন) যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি থেকে তাদের সর্বশেষ সৈন্য নিজ দেশে ফিরে গিয়েছেন। খবর প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
এক বিবৃতিতে জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যানগ্রেট ক্র্যাম্প-ক্যারেনবাউয়ার বলেন, প্রায় ২০ বছর পর আমাদের শেষ সেনারা এই রাতে (মঙ্গলবার) আফগানিস্তান ছেড়ে গেছে এবং তারা বাড়ির পথে আছে। এটি একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সমাপ্তি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফগানিস্তানেই জার্মান সামরিক বাহিনী প্রথম স্থলযুদ্ধ করেছিল। দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের পর তাদেরই সর্বোচ্চ সেনা মোতায়েন ছিল। সংখ্যাটা সবমিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ। মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৯ জন এবং এদের মধ্যে যুদ্ধ বা জঙ্গি হামলায় নিহত হন ৩৫ জন।
জার্মান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, আফগানিস্তান থেকে তাদের সব সেনা দেশে ফিরছে। সেখানে আর একজনও জার্মান সেনা নেই। তবে নিরাপত্তার কারণেই তারা এনিয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়নি।
২০০২ সালের জানুয়ারিতে জার্মানির সেনারা আফগানিস্তান যায়। প্রথমে বলা হয়েছিল, তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধ করা নয়, আফগানিস্তানের স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করবে জার্মান সেনারা।
এরপর থেকে ধাপে ধাপে সবমিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ জার্মান সেনা আফগানিস্তান গেছেন। অনেকে একাধিকবারও সেখানে গেছেন। তাদের খরচ সামলাতে দেশটির এক হাজার ২৫০ কোটি ইউরো খরচ হয়েছে। এছাড়া আফগানিস্তানে ৫৯ জন জার্মান সেনা নিহত হয়েছেন।
গজনি দখলে তালিবানের হামলা শুরু
আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলীয় শহর গজনি দখলে নিতে সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা শুরু করেছে তালিবান। মঙ্গলবার তারা রাজধানী কাবুলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ কান্দাহারের সংযোগ মহাসড়কে ভারী অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। খবর আল জাজিরার।
আফগান সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সংঘর্ষের সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, সরকারি বাহিনী হারানো এলাকার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আল জাজিরার খবর অনুসারে, এদিন আফগান-তালিবান সংঘর্ষ সবচেয়ে বেশি হয়েছে শেখ আজাল ও গঞ্জ এলাকার নিরাপত্তা চৌকিগুলোর কাছে। এতে ওইসব এলাকার ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানকার বেশিরভাগ রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। টেলিকমসেবা বিঘ্নিত হওয়ায় সহায়তা সংগঠন ও সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য হতাহতের সংখ্যা নির্ণয় কঠিন হয়ে পড়েছে।
গজনিসহ আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশে তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কিছু সাধারণ নাগরিক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ