কোনওভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না পাহাড় কাটা। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন-২০১০-এও স্পষ্টভাবে পাহাড় বা টিলা কাটার ওপর স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দেয়া রয়েছে। এছাড়া পাহাড়ি এলাকায় ভবন নির্মাণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের অবস্থানগত ছাড়পত্র নেয়ার নিয়ম রয়েছে। তারপরেও চট্টগ্রাম নগরীর আবাসন খাতের বেশকিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে অভিজাত বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। কিছু প্রকল্পে পাহাড় এমনভাবে কাটা হয়েছে যে সেখানে কোনওকালে পাহাড় ছিল তার সামান্যতম চিহ্নও রাখা হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, চট্টগ্রামে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য পাহাড় কাটা হচ্ছে অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই। অন্যদিকে অধিদপ্তরকেও কাজ করতে হচ্ছে নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে। ফলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষেও এখন পাহাড় কাটা বন্ধ করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
অসহায় পরিবেশ অধিদপ্তর
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, চট্টগ্রামের অনেক স্বনামধন্য শীর্ষ পর্যায়ের আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতি করে ভবন নির্মাণের সত্যতা পেয়েছি। অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও তারা ছাড়পত্রের তোয়াক্কা করেনি। পাহাড় কাটলে আমরা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কিন্তু পাহাড় রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা পরিবেশ অধিদপ্তরকে সেভাবে দেয়া হয়নি। তবে দেশের স্বার্থে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।
তাছাড়া কোনো স্থানে পাহাড় কাটা হলে তার তথ্যও পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানানো হয় না। আবার অভিযোগ পেয়ে মামলা করার পর আমরা সাক্ষী জোগাড় করতে পারি না। নানা পক্ষের অসহযোগিতার কারণে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা চালানোও কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের আরো অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমাদের কাজ চালাতে হচ্ছে।
জানা যায়, বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনুমোদন গ্রহণেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সিডিএর কর্মকর্তারা জানান, বড় বড় আবাসন কোম্পানির পাহাড় কাটার ঘটনা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবাসন কোম্পানিগুলো সিডিএর নকশা অনুমোদনের সময় পাহাড়ের উপস্থিতির বিষয়টি জানায় না। আবার প্রকল্প এলাকায় পাহাড় বা টিলা আছে কিনা সে বিষয়ে যাচাই-বাছাই না করেই সিডিএর অনুমোদন দিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক।
যা বলছেন পরিবেশবিদরা
পরিবেশবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম এলাকায় বর্ষাকালে প্রাণঘাতী ভূমিধস ও কাদার প্রবাহ নেমে আসার প্রধানতম কারণ হলো পাহাড় কাটা। এর বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিষয়ে ঔদাসীন্য রয়েছে। এ ঔদাসীন্য কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
পরিবেশবিদ ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য পাহাড়। কিন্তু প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো দিন দিন দখলে গিয়ে বিলাসবহুল প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কেউ দখল করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ভাড়া দিচ্ছে। আবার কেউ আবাসন প্রকল্পের নামে পাহাড় কেটে সুউচ্চ আবাসন ভবন তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করছে।
এ পাহাড়ের ওপর প্রকল্পগুলোর নকশা সিডিএ কীভাবে অনুমোদন দেয়, সেটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে। নগরীর সৌন্দর্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পাহাড় সংরক্ষণ করা জরুরি।
পাহাড় কেটে স্যানমার প্রপার্টিজের জালিয়াতি
অবৈধভাবে পাহাড় কেটে এমনই এক বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে স্যানমার প্রপার্টিজের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন আরেফিননগর বাজারে বাইপাস রোডের দক্ষিণ-পশ্চিমে পাহাড় কেটে ২৬ তলা ভবন নির্মাণ করছে তারা। প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে মহানগর সমিতির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ভিত্তিতে। সূত্র বণিক বার্তা।
প্রকল্পের প্ল্যান দেখিয়ে ২০১৬ সালে প্রতি বর্গফুট কমপক্ষে ৬ হাজার টাকা মূল্যে ফ্ল্যাট বিক্রি শুরু করে স্যানমার প্রপার্টিজ। গ্রাহকদেরও রাখা হয় অন্ধকারে। তবে পাহাড় কাটা নিয়ে স্থানীয়রা আপত্তি তোলার পরই শুরু হয় বিপত্তি। পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরে আসে বিষয়টি। এরপর সেখানে অবৈধভাবে পাহাড় কাটার সত্যতা পাওয়া যায়। বর্তমানে স্যানমার প্রপার্টিজের ‘স্যানমার গ্রিন পার্ক’ শীর্ষক প্রকল্পের স্থানে পাহাড় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যদিও স্যানমার প্রপার্টিজ এরই মধ্যে প্রকল্পটির বেশির ভাগ ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছে।
এমনকি এখনো নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকল্পটিতে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বিক্রির প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে এখানে ফ্ল্যাট ক্রয় করা গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পেতে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছেন স্যানমার কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু বেশ কয়েকবার নোটিশ দেয়ার পরও অর্থ ফেরতের বিষয়ে যথাযথ প্রতিশ্রুতি পাননি তারা। অনেক গ্রাহক এখন আইনি পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়েও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন বলে জানা গিয়েছে।
স্যানমার প্রপার্টিজের বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের এটিই একমাত্র অভিযোগ নয়। উত্তর খুলশী থানার ইম্পেরিয়াল হিলের ১০৯/সি নং প্লটের ৪ নম্বর রোডে ছয়তলার অনুমতি নিয়ে ১২ তলা ভবন নির্মাণেরও অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। সম্প্রতি খুলশীর স্থানীয় ১১ জন বাসিন্দার পক্ষে এ নিয়ে স্যানমারের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিন আলম।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে, স্যানমার গ্রানডি নামের উঁচু ভবনটি নির্মাণ করতে গিয়ে এরই মধ্যে প্রায় ৬০ ফুট পাহাড় কেটেছে স্যানমার। ওই স্থানে এখন আর পাহাড়ের চিহ্ন নেই। ভবনটি তৈরি করতে গিয়ে ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২-এর ১২ ধারা এবং সিডিএ আইন ২০১৮-এর ৪৪ ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এছাড়া সেখানে যান চলাচলের জন্য প্রশস্ত কোনো সড়কও নেই। ফলে ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ড বা বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে উদ্ধার তৎপরতা চালানোও বেশ দুষ্কর হয়ে পড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ