কোভিডের সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা ঘিরে প্রশ্ন ওঠার পর এবার ভুয়া করোনার টিকাকেন্দ্র এবং টিকাকরণের ‘রেকর্ড’ গড়তে বিজেপি সরকারের ইচ্ছাকৃতভাবে কম মানুষকে টিকা দেয়ার অভিযোগে বিতর্কিত ভারত। প্রশাসনের নাকের উপর খোলা ওই ভুয়া টিকাকেন্দ্রের কর্ণধারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যদিও ওই কেন্দ্র থেকে টিকা নেয়াদের শরীরের কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাবে তা নিয়ে মানুষের মনে সৃষ্টি হচ্ছে আতঙ্ক। প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনের কার্যকারিতা নিয়েও। এদিকে, রাজনৈতিক বাহবা নেয়ার জন্য সরকারের ‘রেকর্ড’ গড়ার মানসিকতার বিরুদ্ধে সরব সাধারণ মানুষ এবং বিরোধীরা। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি এক দিনে ৯০ লাখ মানুষকে টিকা দিয়ে সারাদেশে প্রশংসিত হয়েছে মোদি সরকার। যদিও সরকারের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে কটাক্ষ করে কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম বলেন, ‘রোববারে মজুত, সোমবার টিকা, মঙ্গলবার ফের খোঁড়ানো শুরু। এক দিনে টিকাকরণে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার এটাই নেপথ্য রহস্য।’
কলকাতায় দেয়া হচ্ছে ভুয়া করোনার টিকা
করোনায় বিপর্যস্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় খোঁজ মিলল ভুয়া এক টিকাকেন্দ্রের। গ্রেপ্তার করা হয়েছে কর্ণধারকে। অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রটি থেকে শত শত মানুষকে ভুয়া টিকা দেয়ার। সূত্র মতে, ওই কেন্দ্রের কর্ণধার নিজেকে কলকাতা পৌর করপোরেশনের যুগ্ম কমিশনার হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন স্থানে টিকাদান শিবির চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজেকে একজন আইএএস কর্মকর্তা হিসেবেও পরিচয় দেন তিনি।
গত মঙ্গলবার এই টিকাকেন্দ্রে টিকা নেন তৃণমূল সাংসদ ও অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। কিন্তু টিকা দেয়ার পর তাকে কোনও সনদ দেয়া হয়নি। তাকে বলা হয়, মুঠোফোনে পাঠানো হবে সনদ। পরে মুঠোফোনেও সনদ না এলে মিমির সন্দেহ হয়। এরপরই তিনি শরণাপন্ন হন কসবা থানার। পুলিশ তদন্তে নেমে কসবার রাজডাঙ্গায় অবস্থিত কেন্দ্রটি ভুয়া হিসেবে জানতে পারে। এরপর এই কেন্দ্রের কর্ণধার ২৮ বছরের যুবক দেবাঞ্জন দেবকে গ্রেপ্তার করে।
সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সরকারি স্টিকার লাগিয়ে গাড়িতে চড়তেন তিনি। ছিল সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীও। দেবাঞ্জনের চালচলনে এতটুকু ঘাটতি ধরা পড়েনি। তিনি কসবার টিকাকেন্দ্রে গত ১০ দিনে বিনা মূল্যে টিকা প্রদান করেন প্রায় দেড় হাজার মানুষকে। টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা আদায় করেন তিনি। চাঁদা হিসেবে নেন লাখ লাখ রুপি।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, শুধু কসবায় নয়, কলকাতার সিটি কলেজেও টিকাদান ক্যাম্প খুলে কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদেরও ভুয়া টিকা প্রদান করেছেন তিনি। পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, দেবাঞ্জন দেব বিভিন্ন ক্যাম্পে কোভিশিল্ড, কোভ্যাকসিন ও স্পুতনিক-৫ টিকা দিয়ে আসছিলেন।
বৃহস্পতিবার পৌর করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান কাউন্সিলর অতীন ঘোষ জানান, দেবাঞ্জন যে টিকা দিয়েছেন, তা আদৌ কোভিশিল্ড, কোভ্যাকসিন বা স্পুতনিক নয়। আসল কোভিশিল্ডের মতো দেখতে হলেও ভায়ালে উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোউত্তীর্ণের তারিখ বা উৎপাদনকারী কোম্পানির নাম নেই। শুধু কোভিশিল্ড লেখা। ফলে এই ভায়াল জাল বলে মনে করছে পৌর করপোরেশন।
পুলিশ এখন খোঁজ করছে এই দেবাঞ্জনের সঙ্গে আর কারা জড়িত। কারণ, দেবাঞ্জন একটি বিরাট দল নিয়ে এই প্রতারণা চালাচ্ছিলেন। তার রয়েছে বেশ কয়েকজন কর্মচারী, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী। প্রচুর অর্থ দিয়ে তাদের রাখা হয়েছে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে দেবাঞ্জন বলেছেন, তিনি এই টিকা কিনেছেন কলকাতা বড়বাজারের ওষুধের পাইকারি বাজার বাগরি মার্কেট থেকে। পরে পুলিশ দেবাঞ্জনের কসবার দপ্তরে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু ভুয়া টিকা উদ্ধার করেছে।
কলকাতা পৌরসভা মনে করছে, দেবাঞ্জন করোনা টিকার নামে হাম বা বিসিজি টিকাও দিতে পারেন। উদ্ধার হওয়া ওই টিকা পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থায় পাঠানো হচ্ছে। তবে জাল কোভিশিল্ডের ভায়ালে কোভিশিল্ডসহ মিক্সড ভ্যাকসিন লেখা রয়েছে।
চিকিৎসক অজয় সরকার বলেছেন, মিক্সড মানে একটি পাউডার ও পানি মিলিয়ে তৈরি করা হয় টিকার ডোজ। এখন তদন্ত করে দেখা উচিত, শরীরে দেওয়া ওই টিকার পরিবর্তে কী দিয়েছিলেন তিনি। এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা আছে কি না বা এরই মধ্যে তা হয়েছে কি না, সেগুলোও দেখা দরকার।
যেসব মানুষ এই টিকা নিয়েছেন, কলকাতা পৌর করপোরেশন তাদের ঠিকানা নিয়ে খোঁজ শুরু করেছে। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার খবর মেলেনি। ইতিমধ্যে কলকাতার সাধারণ মানুষ অভিযোগ তুলেছেন, কীভাবে কলকাতা পৌর করপোরেশনের নামে শহরে এ ধরনের ভুয়া টিকাকেন্দ্র খুলে প্রতারণা করেছেন দেবাঞ্জন, তা নিয়ে।
তার কসবার টিকাকেন্দ্রে পৌর করপোরেশনের লোগোসহ বোর্ড লাগানো রয়েছে। বলা হয়েছে, পৌর করপোরেশনই এই টিকাকেন্দ্র স্থাপন করে মানুষকে বিনা মূল্যে টিকা প্রদান করছে।
ইচ্ছাকৃতভাবে কম মানুষকে টিকা দেয়া হচ্ছে
করোনা নিয়ে নানা অভিযোগে বিদ্ধ বিজেপি। এবার অভিযোগ, দল ও প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে বিজেপিশাসিত বেশ কয়েকটি রাজ্যে টিকা মজুত করা হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। আর এর উদ্দেশ্য টিকাকরণে ‘রেকর্ড’ গড়া।
প্রসঙ্গত, বিরোধীদের চাপ ও সুপ্রিম কোর্টের বিরূপ মনোভাব আন্দাজ করে দেশব্যাপী ১৮ বছরের ঊর্ধ্বদের ৭৫ শতাংশের টিকাকরণের দায় কেন্দ্রীয় সরকার হাতে নেয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেই জাতির প্রতি ভাষণে সেই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২১ জুন থেকে গণটিকাকরণের সেই কর্মসূচি শুরু হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, প্রথম দিন সারা দেশে ৮৬ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। কো-উইন অ্যাপ অনুযায়ী সংখ্যাটি আবার ৯০ লাখ। অভাবিত এই সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী সবাইকে অভিনন্দনও জানান। তার নেতৃত্বের জয়গান গেয়ে শুরু হয় বিজেপি নেতাদের টুইট। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন মঙ্গলবার বলেন, এক দিনে এত জনকে টিকা দিয়ে ভারত বিশ্বে রেকর্ড গড়ল। যদিও ৯ জুন আন্তর্জাতিক ‘নেচার’ ম্যাগাজিন জানিয়েছিল, চীন এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দৈনিক দুই কোটি মানুষকে টিকা দিয়েছে।
অথচ পরের দিন, ২২ জুন সারা দেশে টিকা দেওয়া হয় মাত্র ৫৪ লাখ ২৪ হাজার জনকে! সংখ্যায় এই পতনের পর থেকেই শুরু হয় ‘রেকর্ড’ গড়ার নেপথ্য রহস্যের অনুসন্ধান।
দেখা যায়, বহু বিজেপিশাসিত রাজ্য ২১ জুন রেকর্ড গড়ার উদ্দেশ্যে কদিন ধরেই টিকা মজুত করছিল। ইচ্ছাকৃতভাবে কম মানুষকে টিকা দিচ্ছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এমন ১০টি রাজ্যের মধ্যে ৭টিই বিজেপিশাসিত। দেখা যায়, ১৬ থেকে ২০ জুন সারা দেশে দৈনিক টিকার পরিমাণ ৪০ লাখের কম। অথচ ২১ জুন তা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ