বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অল্প কিছুদিন আগে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা প্রাণদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। ৮ নভেম্বর খসড়া বিলটি আলোচনার জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। আইনের একজন ছাত্র ও দেশের একজন নাগরিক হিসেবে বিশেষ করে, কিছুদিন লালসালুর উভয় দিকেই কাজ করার সুবাদে আমার মনে হলো যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর কিছু সংখ্যক বিধান, বিশেষ করে এর ধর্ষণ-সংক্রান্ত বিধান সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। যে কোনো আইন প্রণয়নের প্রাথমিক উদ্দেশ্য দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। সে উদ্দেশ্যেই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ বিভিন্ন দেশের সরকার গ্রহণ করে থাকে।
যে কোনো আইন বিশেষ করে ফৌজদারি আইনের দুটি অংশ থাকে। একটি হলো, ‘সাবস্টেনটিভ ল’ বা মূল আইন, অপরটি ‘প্রসিড্যুরাল ল’ বা কার্যবিধি বা কার্যপ্রণালি-সংক্রান্ত আইন। মূল আইনে অপরাধ সংজ্ঞায়িত করা হয় এবং অপরাধের শাস্তির বিধান প্রণীত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, কার্যবিধি-সংক্রান্ত আইনে মূল আইনে বর্ণিত অপরাধের বিচার কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা বর্ণনা করা হয়। আইনের এ দুই অংশই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কার্যবিধি-সংক্রান্ত আইন সঠিকভাবে প্রতিপালন করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ যদি কার্যবিধি-সংক্রান্ত আইন সঠিকভাবে প্রতিপালিত না হয়, তবে ন্যায়বিচার ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। উল্লেখ্য, সংসদ আইন প্রণয়ন করে এবং আইনপ্রণেতা তথা সাংসদরা অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে শাস্তির বিধান করে থাকেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০-এ বর্ণিত বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে অন্যতম ঘৃণ্য অপরাধ হলো ধর্ষণ। ধর্ষণের বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াবলি সম্বন্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০-এর ৯ ধারাতে শাস্তির বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ওই আইনের বিভিন্ন ধারায় বিচার কীভাবে সম্পন্ন হবে, তা আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু কার্যবিধি-সংক্রান্ত কিছু বিধানাবলিতে অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। আশা করব, নতুন আইনে সেই অসংগতিগুলো দূর করে কার্যপ্রণালি বা পদক্ষেপগুলো আরও সুসংহত করা হবে। সেই কার্যবিধি বা কার্যপ্রণালিকে অবশ্যই নারীবান্ধব হতে হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ধর্ষিতা বিচারপ্রার্থী হলে তার যেন সমস্যার আর শেষ থাকে না।
প্রথমত, অপরাধের প্রকৃতিগত দিক থেকে ধর্ষণ সব থেকে জঘন্য এবং অন্যান্য সব অপরাধ থেকে আলাদা। কারণ, এ ক্ষেত্রে ভিকটিমকে একই সঙ্গে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ভিকটিম বা তার পরিবার থানায় অভিযোগ না করার কারণে এ ধরনের অপরাধের একটা বড় সংখ্যা লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে যায়। যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের অপরাধের ক্ষেত্রে যদিও একদিকে থাকে অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে সংযুক্ত শারীরিক কদর্য যন্ত্রণা, অন্যদিকে ভিকটিমের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও এটি মারাত্মক আঘাত হানে। কারণ, এই ধরনের অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে প্রায়শই ভিকটিমের চরিত্র এবং মোটিভের ওপর প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় যা তার ক্ষত আরও রক্তাক্ত করে এবং তাকে পদে পদে নতুনভাবে অপমানের সম্মুখীন করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের প্রচলিত আইন ও সমাজব্যবস্থায় ধর্ষণের শিকারকে ‘কলঙ্কিত’ হিসেবে দেখা হয়। তাক অনেক সময় সামাজিকভাবে একঘরে করা হয়। পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী ও বন্ধুরাও অনেক ক্ষেত্রে তার সঙ্গ পরিত্যাগ করে। ভবিষ্যতে তার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য এবং বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে সে হয় স্বামী পরিত্যক্ত। অনেক ক্ষেত্রেই তার মানসিক যন্ত্রণা ও শারীরিক কষ্ট উপশমের জন্য সামান্য সহানুভূতি জানার জন্য কেউই থাকে না। ফলশ্রুতিতে অনেক সময়েই সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
বিশেষ করে, ধর্ষণের শিকার নারী যদি গ্রামের বাসিন্দা বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হয়ে থাকে, তবে তার দুর্ভোগের সীমা-পরিসীমা থাকে না। তাকে নিয়ে গ্রাম দেশের মাতবর শ্রেণির লোক বা নিপীড়নকারীর লোকজন তাকে উত্ত্যক্ত করে ও সালিশের নামে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এক সময় ধর্ষিতা নারী দেরিতে হলেও থানায় উপস্থিত হয়।
ধর্ষণের শিকার নারীকে সালিশে সেই ন্যক্কারজনক ঘটনার বর্ণনা দিতে হয়। থানায় এজাহার দায়েরের সময় তাকে আবার সেই কষ্টদায়ক ঘটনার বর্ণনা দিতে হয়। এরপর ঘটনার বর্ণনা দিতে হয় তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। অর্থাৎ, তাকে ওই ন্যক্কারজনক ঘটনার বিবরণ বারংবার দিতে হয়! আমাদের আইন এবং প্রতিষ্ঠান এমনভাবে করতে হবে যেন ধর্ষিতা নারী সহজেই আস্থাভাজন এমন কাউকে কাছে পায় যার মাধ্যমে খুব দ্রুতই মেডিকেল পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারবে, যা প্রায়শই অনেকটা দেরি হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে বর্তমান আইনের বিধান দুর্বল। ভবিষ্যতে এ সম্বন্ধে নতুন কোনো আইনে এ বিষয়টি সম্পর্কে কার্যকর বিধান থাকা প্রয়োজন। কারণ যদি ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষায় অতি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে প্রয়োজনীয় আলামত পাওয়া যায় না।
এই ধরনের এক নাজুক অবস্থায় ভিকটিমকে সাহায্য করার জন্য জাতীয় জরুরি সেবা (৯৯৯) এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জরুরি সেবা (১০৯) কার্যক্রম চালু আছে। উল্লিখিত দ্বিতীয় সেবাটিতে যোগাযোগ করা হলে তারা প্রয়োজনীয় তথ্য, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কাউন্সিলিং ইত্যাদি দিয়ে থাকে। তবে, এই ধরনের সেবা এখনও রেপ ভিকটিমের জন্য খুব বেশি কার্যকর হয়েছে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, তা বলা যাচ্ছে না। যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার ভিকটিমদের জন্য ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার এখনও আমাদের দেশে অপ্রতুল। ২০০৯ সাল থেকে ইউএনডিপির সহযোগিতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার’ (ভিএসসি) চালু করেছে, যেখানে এনজিওদের সহযোগিতায় ভিকটিম নারী ও শিশুদের কাউন্সিলিং প্রদান করা হয়। তবে, যতদূর জানি, এ সুবিধা কেবল ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরেই সীমাবদ্ধ। জাতীয় পর্যায়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনার জন্য অবিলম্বে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা জরুরি। ডিজিটাল যুগে এ ধরনের জরুরি সহযোগিতা প্রদান খুবই সম্ভব।
উন্নত দেশগুলোয় নারীরা তাদের ব্যাগে বা জ্যাকেটের পকেটে ছোট্ট একটা ‘ডিভাইস’ সাধারণত বহন করে থাকে। যদি কখনও তারা নিজেদের অনিরাপদ মনে করে অর্থাৎ, তারা ধর্ষণ বা কোনো শারীরিক নিপীড়নের সম্মুখীন হয়, তখন ওই যন্ত্রে চাপ দিলে যন্ত্রটি প্রচণ্ড শব্দ করে। ফলে নিপীড়নকারী চমকে যায় কিংবা আশপাশের লোকজন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। ফলে ধর্ষণ রোধ করা সম্ভব হয়।
আমাদের দেশের নারীরাও যদি এমন যন্ত্র তাদের সঙ্গে বহন করে, তাহলে ধর্ষণের পরিমাণ অনেক কমে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। সরকারের উচিত ডিভাইসটি বিনা শুল্ক্কে আমদানির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। প্রয়োজনে তা আমাদের দেশেই উৎপাদন করা যায় এবং স্কুলে-কলেজের মেয়েদের সরকারিভাবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিতরণ করা সম্ভব। এতে ধর্ষণ পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব না হলেও অনেকটাই কমিয়ে আনা যাবে। তাছাড়া, যেহেতু ধর্ষণ একটি ‘নন কম্পাউন্ডেবল’ ও ‘কগনিজেবল’ অপরাধ, তাই ধর্ষণের অভিযোগ এলে কোনো সালিশ চলবে না। যদি সালিশের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে সালিশকারীদেরও শাস্তির আওতায় আনা দরকার।
দ্বিতীয়ত, ভিকটিমকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেডিকেল পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক উপজেলায় সমাজসেবা কর্মকর্তা এ ব্যাপারে ধর্ষিতা নারীর পাশে দাঁড়াতে পারে ও দ্রুত মেডিকেল পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। অতঃপর তাকে নিয়ে থানায় গিয়ে এজাহার লিপিবদ্ধ করার পদক্ষেপ নেবেন। এ ছাড়া জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে নিয়োজিত নারী বিষয়ক কর্মকর্তা কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে ধর্ষিতা নারীর জন্য আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ সহজতর হবে। কথাগুলো এজন্য বলছি কারণ, ধর্ষণের পর একজন নারী মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকেন; চরম অপমানজনক ঘটনার শিকার হওয়ার কারণে তার স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি কাজ করে না। লজ্জায়-দুঃখে তখন কারও মুখের দিকে পর্যন্ত তাকাতে পারে না; কিন্তু ওই অবস্থাতেই তাকে ওই অপমানজনক ঘটনার বিবরণ বারবার বিভিন্ন জনের কাছে দিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য একজন সংবেদনশীল নারী কর্মকর্তার প্রয়োজন।
এসব পদক্ষেপ একজন সরকারি ও সংবেদনশীল কর্মকর্তা ভিকটিমের পক্ষে তদারকি করলে তাতে তিনটি কাজ হবে- আলামত দ্রুত সংগ্রহ করা সম্ভব হবে, আলামত সঠিক সময় সঠিক জায়গায় পৌঁছাবে, তদন্তকার্য সঠিক সময়ে সঠিকভাবে আরম্ভ হবে। অনেকেই মনে করেন, ধর্ষণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেল পরীক্ষা করলেই চলবে। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন ডাক্তারের অভিমত এই- মেডিকেল পরীক্ষা যত তাড়াতাড়ি, অন্তত ছয়-সাত ঘণ্টার মধ্যে করতে পারলে আলামত পাওয়া সম্ভব হয়। দেরি হলে বা ধর্ষণের শিকার নারী টয়লেটে বা বাথরুমে গেলে আলামত প্রায়শই নষ্ট হয়ে যায়।
আইনে এমন বিধান রাখতে হবে যাতে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন-সংক্রান্ত ঘটনার ভিকটিমের তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা বা মেডিকেল ট্রিটমেন্ট দিতে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের প্রয়োজনীয় খরচাদি সরকার বহন করবে। পাশাপাশি হাসপাতাল বা ক্লিনিক তাৎক্ষণিক পুলিশকে ঘটনাটি অবহিত করবে।
উন্নত বিশ্বে এই ধরনের ভিকটিমকে পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে ও এমনকি প্রত্যেকটি পুলিশ স্টেশনে ‘রেপ কিট’ থাকে। একজন ভিকটিম অপরাধ সংঘটনের পর নিজেই অথবা কোনো নার্স বা নারী পুলিশের সহায়তায় আলামত সংগ্রহ করতে পারে। আমাদের দেশেও এ ব্যবস্থা করা সম্ভব।
লেখক : বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি।
সূত্র: সমকাল
আপনার মতামত জানানঃ