অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তিতে চীনের উত্থান বিশ্বশক্তি আমেরিকার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি ও চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠেছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের দীর্ঘদিন টানাপোড়েন চলছে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় তা তলানীতে পৌঁছে। উভয় দেশ একের পর এক বিভিন্ন পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও কর আরোপ করে এ সম্পর্ককে রীতিমতো বাণিজ্য যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
যদিও জো বাইডেন আসার পর এ সম্পর্ক শিথিলের আভাস মিলেছিল। কিন্তু বাইডেন ইতিমধ্যে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তার দেশ ইন্দো-প্যাসিফিকে সামরিক অবস্থান আরো শক্ত করবে। তিনি এ সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর পেছনে সংঘাত প্রতিরোধের দোহাই দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই বেইজিং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছিল। ওয়াশিংটন সে প্রচেষ্টায় বাধ দিতেই এমন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ বহরের (সারফেস শিপ) ৬০ শতাংশই ইন্দো-প্যাসিফিকে মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে। এক্ষেত্রে বিশালায়তনের এ নৌবহর পরিচালনার জন্য ঘাঁটি স্থাপনের পাশাপাশি রিফুয়েলিং ও লজিস্টিক সহায়তারও প্রয়োজন হবে। এজন্য সংলগ্ন আরব সাগর, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং বঙ্গোপসাগরে নিরাপদ স্থানের খোঁজে রয়েছে মার্কিন নৌবাহিনী।
ইউরেশিয়া টাইমস জানাচ্ছে, ২০০৪ সালে গ্লোবাল ডিফেন্স পোসচার রিভিউ (জিডিপিআর) পরিকল্পনা গ্রহণের পর থেকেই ইন্দো-প্যাসিফিকে ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ খুঁজছে পেন্টাগন। জিডিপিআরে স্নায়ুযুদ্ধকালে জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থাপিত ঘাঁটিগুলোকে আরো শক্তিশালী করা বা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে এ পরিকল্পনায় নতুন নতুন ঘাঁটি স্থাপনেরও কথা বলা হয়।
ইন্দো-প্যাসিফিক বলতে পূর্ব আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার উপকূলীয় দেশগুলো থেকে ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরজুড়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রসারিত সমুদ্রস্হানকে বোঝায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে,-“ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস)” অঞ্চলটি ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দুটি অঞ্চল, আমেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত।
যে অঞ্চলটিকে এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সে অঞ্চলটি মূলত, এশিয়া প্যাসিফিক হিসেবে বহুল পরিচিত। তবে ২০১১সাল থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক, শব্দগুচ্ছটি ভূ-কৌশলগত ও ভূ- রাজনৈতিক আলোচনায় ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, চীনের ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইলের ভাণ্ডার এখন অনেক সমৃদ্ধ। আওতা ও নির্ভুলতার দিক থেকেও এসব মিসাইল বেশ উন্নত। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বিদ্যমান মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তা নিয়েও এক ধরনের শঙ্কা তৈরির অবকাশ রয়েছে।
পেন্টাগনের ইন্দো-প্যাসিফিকে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে চাওয়ার পেছনে এ শঙ্কাও কাজ করতে পারে। এ কারণে বর্তমানে চীনের কাছাকাছি এলাকাগুলোয় একাধিক নতুন ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক সম্পদকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা সম্ভব হবে। একসঙ্গে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা চীনের জন্যও বেশ কঠিন হবে।
ভারত তার কৌশলগত স্বার্থের জন্যই ভারত মহাসাগরে নৌবাহিনীর শক্ত অবস্থান রেখেছে। কিন্তু চীন পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে এ অঞ্চলে তার আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ অঞ্চলে চীনের আধিপত্য তার জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকি বলে একাধিবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জন র্যাটক্লিফ বলেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বৈশ্বিক গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য চীন সবচেয়ে বড় হুমকি।
সামগ্রিকভাবে ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করতে যাওয়ার কিছু অসুবিধাও রয়েছে। জটিল ভৌগোলিক গঠনের ইন্দো-প্যাসিফিকে উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব একটা সহজ নয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অধিকাংশই নিজ ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটি স্থাপন করতে দিতে নারাজ। এক্ষেত্রে সংঘাত এড়িয়ে চলার প্রবণতা যেমন ক্রিয়াশীল, তেমনি রয়েছে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশও। এছাড়া রসদ-সংক্রান্ত জটিলতাও এক্ষেত্রে বড় একটি বিষয়।
সামরিক ও ভূরাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ইন্দো-প্যাসিফিকে দক্ষিণ এশীয় পরিমণ্ডলে নৌঘাঁটি স্থাপনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান হলো বঙ্গোপসাগর বা সংলগ্ন এলাকা। গত বছর এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর বড় একটি সুযোগও তৈরি হয়। চীনের সঙ্গে ভারতের সামরিক সংঘাত নয়াদিল্লিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি ঠেলে দেয়। ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে কোয়াড জোটকে সক্রিয় করে তোলে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে বেশকিছু সামরিক মহড়াও আয়োজন করে।
কিন্তু এর পরও কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করছেন, এ অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি নয়াদিল্লির জন্য অনেক বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে উষ্ণতা পেলেও এক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থহানির বড় সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এর মধ্য দিয়ে ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যে ভাগ বসাবে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি যত জোরালো হবে, ভারতের আধিপত্য ততটাই খর্ব হবে।
অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও ঘাঁটি স্থাপন নিয়ে সমস্যায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইন্দো-প্যাসিফিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতার আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো তাইওয়ান। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাইওয়ান ইস্যুতে চীনকে মোকাবেলা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
মার্কিন থিংকট্যাংক আরএএনডি জানিয়েছে, চীন তাইওয়ানে হামলা চালালে তা মোকাবেলার জন্য তাইপের আনরিফুয়েলড কমব্যাট রেডিয়াসের (যেটুকু এলাকার মধ্যে হামলা চালিয়ে ফিরে আসতে যুদ্ধবিমানের পুনরায় জ্বালানি গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না, এক হাজার কিলোমিটারের কিছু কম এলাকা) মধ্যে মার্কিন বিমানঘাঁটি রয়েছে মোটে দুটি। অন্যদিকে তাইপে থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে চীনা বিমানঘাঁটি রয়েছে ৩৯টি। ফলে এ এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের চীনের আক্রমণ মোকাবেলার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এসব দিক বিবেচনায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঘাঁটি করতে দেয়ার মতো সহযোগী দেশ খুঁজছে পেন্টাগন। এক্ষেত্রে সামরিক ও কূটনৈতিক সব চ্যানেলকেই কাজে লাগানো হচ্ছে বলে ইউরেশিয়া টাইমসের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এদিকে দৃশ্যত দক্ষিণ এশিয়া/ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনা শত্রুতার মধ্যে আটকা পড়েছে বাংলাদেশ। বিশেষত, এই প্রতিযোগিতা বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের চেয়েও বেশি বলে মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাবের একটি বলয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কৌশলগত এই প্রতিযোগিতায় নৌশক্তিগুলো যদি বঙ্গোপসাগরে দৃশ্যমান অনুপ্রবেশ ঘটে তাহলে বড় সংঘাত বেধে যাওয়ার সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করতে পারেন না দূরদর্শী নীতিনির্ধারক ও কৌশল বিশ্লেষকরাও।
প্রতিবেশী মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বঙ্গোপসাগরে বিরোধী নৌশক্তিগুলোর মধ্যে বিরোধ আরো খারাপ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এর ফলে এমন সংঘর্ষের সম্ভাবনা রয়ে গেছে। এভাবেই পাশের বাড়ির অশান্ত অবস্থা ছড়িয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশের ভূখন্ডে। যেমনটা উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাঁ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনও বলেছেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় কক্সবাজারে কমপক্ষে ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য অস্থিতিশীলতার উৎস হয়ে উঠতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩৪৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ