স্থানীয়দের সূত্র মতে, গতকাল অন্তত সাতবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট এলাকায়। আজ ভোররাতেও কেঁপে উঠেছে সিলেট। আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শক্তিশালী ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস হতে পারে এগুলো। এমনকি আট মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনাও আছে। সাধারণত বড় কোন ভূমিকম্পের আগে বা পরে এমন দফায় দফায় মৃদু কম্পন হতে পারে। ডাউকি ফল্ট লাইন নিয়ে বাড়ছে চিন্তা। এদিকে দফায় দফায় এমন কম্পনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে স্থানীয়দের মধ্যে।
ভোররাতে ফের ভূমিকম্প
আবারও ভোররাতে সিলেটে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। আজ রোববার ভোররাত ৪টা ৩৫ মিনিটের দিকে এ ভূকম্পন হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ২ দশমিক ৮।
ঢাকা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মুমিনুল ইসলাম বলেন, আজ ভোররাত ৪টা ৩৫ মিনিটের দিকে মৃদু কম্পনটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ২ দশমিক ৮। ঢাকা থেকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ২০৫ কিলোমিটার। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটের সীমান্তবর্তী ডাউকি এলাকায়। ভূমিকম্পটি ‘মাইনর’ হওয়ায় অনেকেই হয়তো সেটি বুঝতে পারেননি।
এই আবহাওয়াবিদ বলেন, ‘উৎপত্তিস্থলটি আমরা সিলেট অঞ্চল হিসেবেই পেয়েছি, সেটি সীমান্তবর্তী ডাউকি এলাকায়। শুধু সিলেট স্টেশন থেকে ভূকম্পনের সিগন্যালটি এসেছে। অন্য কোনো স্টেশন থেকে সিগন্যাল আসেনি।’
হেলে পড়েছে ছয়তলা দু’টি ভবন
সিলেটে টানা ভূমিকম্পে হেলে পড়েছে দু’টি ছয়তলা ভবন, বাসিন্দাদের ওই ভবন থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে। গতকাল শনিবার (২৯ মে) সকালে ভূমিকম্পের পর নগরীর পাঠানটুলা দর্জিবাড়ি মোহনা আবাসিক এলাকার বি ব্লকে এ ঘটনা ঘটে। ভূমিকম্পে দুইটি ৬ তলা ভবন একটি অপরটির দিকে অন্তত দুই ফুট হেলে পড়ে।
খবর পেয়ে শনিবার রাতেই তিনি মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ, সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী আংশুমান ভট্টচার্য্য, রাজু উদ্দিন আহমদ ও লিপু সিংহকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
মেয়রের পরামর্শে আজ রোববার সকাল থেকে ভবন দু’টির বাসিন্দারা অন্যত্র সরে যেতে শুরু করেন।
মেয়র আরিফুল বলেন, ভবন দু’টি যথাযথভাবে নির্মাণ করা হয়েছে কিনা বা অনুমোদন নেয়ার পর কোন পরিবর্তন করা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শক্তিশালী ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস
ভূমিকম্পের গতি, প্রকৃতি ও এ সংক্রান্ত গবেষণারত সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাক আহমদ বলেন, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের ডাউকি ফল্টের অবস্থান সিলেট শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এটি খুব বিপজ্জনক ফল্ট। তাই সিলেটও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে।
তিনি বলেন, এক দিনে কয়েক দফা কম্পন শক্তিশালী ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস; যদিও ঘন ঘন কম্পন শক্তিশালী ভূমিকম্পকে কিছুটা দুর্বল করে দেয়।
ঢাকা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মুমিনুল ইসলাম বলেন, সিলেটে এমন আর কখনো হয়নি। যদিও সিলেট অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে। বিশেষ করে তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশে। সিলেটের জৈন্তায় আজকের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। তবে সবগুলোই ছোটো ধরনের ভূমিকম্প।
তিনি আরও বলেন, ভূমিকম্পের প্রিশক ও আফটারশক থাকে। অনেক সময় বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট কম্পন হয়। আবার বড় ভূমিকম্প হলে তারপর ছোট ছোট কম্পন হয়। যেহেতু সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়া ওই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন সকালের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটেরই জৈন্তা এলাকা।
তিনি বলেন, সিলেটের জৈন্তা এলাকার ডাউকি ফল্টেই সকালের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হিসেবে আমাদের কেন্দ্রে আমরা চিহ্নিত করেছি। ডাউকি ফল্ট পূর্ব পশ্চিমে প্রায় তিনশ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই পলিমাটি দিয়ে ঢাকা।
ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা করছেন অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তার গবেষণা মডেল বলছে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান।
তিনি জানান, বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। তবে গতকালকের প্রথম ভূমিকম্পটি ভালোভাবে বোঝা গেলেও পরেরগুলো ছিলো আরও মৃদু কম্পন অর্থাৎ খুবই হালকা ধরনের।
আরও বলেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দুটি অঞ্চলে যেভাবে শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে বহুকাল ধরে তাতে আট মাত্রার পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে যদি একবারে হয়। হলে একবারেও হতে পারে আবার ভেঙ্গে ভেঙ্গে বা দফায় দফায়ও হতে পারে। কিন্তু কোন মাত্রার হবে এটা আগে থেকে অনুধাবন সম্ভব না।
একদিনে অন্তত পাঁচবার কেঁপে উঠেছে সিলেট
দফায় দফায় কেঁপে উঠছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সিলেট। এর আগে গতকাল শনিবার সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে চারবার কম্পন অনুভূত হয়। সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে, সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে, বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে ও বেলা ১টা ৫৮ মিনিটে কম্পন অনুভূত হয়েছিল। এর মধ্যে রিখটার স্কেলে সর্বোচ্চ কম্পনের মাত্রা ছিল সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে, ৪ দশমিক ১। তবে স্থানীয় সাংবাদিক আহমেদ নূর গণমাধ্যমকে বলছেন সকাল থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত অন্তত পাঁচবার ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে।
এসিকে, মুমিনুল ইসলাম বলছেন, বেলা তিনটা পর্যন্ত পাঁচ বার কম্পন অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি হলো ৪.১, ৪, ৩ এবং ২.৮ মাত্রার। কোন কোনটি এতো মৃদু যে সব স্টেশনে মাত্রা মাপাও যায়নি।
ভূমিকম্প হলে করণীয় বিষয়ে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন জানান, দেশে ভূমিকম্পন প্রবণ যে এলাকাগুলো রয়েছে সিলেট তারমধ্যে অন্যতম। ভূমিকম্প হলে আতঙ্কিত না জীবন রক্ষার্থে যা যা করণীয় তা করতে হবে। নিজেকে ধীরস্থির ও শান্ত রাখতে হবে। বাড়ির বাইরে থাকলে ঘরে প্রবেশ করা যাবে না। বহুতল দালানের ভেতরে থাকলে টেবিল বা খাটের নিচে চলে যেতে হবে। জানালা বা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নামার চেষ্টা করা যাবে না।
ডাউকি ফল্ট লাইন
ডাউকি ফল্ট লাইন বা ফাটল রেখার অবস্থান সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের উত্তরে সীমান্তজুড়ে যা ভারতের শিলং মালভূমি এর দক্ষিণ সীমানা। ১৮৯৭ সালে ডাউকি ফল্ট লাইনে ৮ মাত্রারও বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হয়, যার তীব্রতা কলকাতা ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে এবং মিয়ানমার পর্যন্ত অনুভূত হয়।
ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘আমাদের গবেষণা বলছে ডাউকি ফল্ট লাইন এবং চট্টগ্রাম বিভাগের পূর্ব সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা ফোল্ড বেল্ট এ প্রচুর পরিমাণে স্ট্রেইন এনার্জি (ভূমিকম্পের শক্তি) কয়েকশ বছর ধরে জমা হয়ে আছে। এই শক্তি যখন ছেড়ে দিবে, তখন বড় ভূমিকম্প হবে।
তিনি বলেন, ‘ডাউকি ফল্ট লাইনে যে শক্তি আছে, তাতে ৭.৫ থেকে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে এবং চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা ফোল্ড বেল্টে ৮.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো শক্তি জমা আছে।’
ড. হুমায়ুন আখতার বলেন, বড় ভূমিকম্পের আগে এরকম ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। সে থেকে ধারণা করা যায় আগামী এক-দুইদিন থেকে এক-দুই মাসের মধ্যে ডাউকি ফল্টে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাবির ভূতত্ত্ব বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, বিজ্ঞান এখনো সে অবস্থায় যায়নি যাতে আমরা আগে থেকেই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ঠিক কোন সময়ে কত মাত্রার ভূমিকম্প হবে। তাছাড়া ফল্ট লাইনে জমা শক্তি যদি একসাথে বের হয় তাহলে সেটা ভয়াবহ বিপজ্জনক। কিন্তু যদি সেটা একটু একটু করে বের হয়, তখন ভয়ের কারণ কমে যায়।
ভূমিকম্পে যা কিছু করণীয়
- ভূমিকম্পের প্রথম ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিন।
- ঘরে হেলমেট থাকলে মাথায় পরে নিন, অন্যদেরও পরতে বলুন।
- ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সম্ভব হলে আশেপাশের সবাইকে বের হয়ে যেতে বলুন।
- দ্রুত বৈদ্যুতিক ও গ্যাসের সুইচ বন্ধ করে দিন।
- কোনো কিছু সঙ্গে নেওয়ার জন্য অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
- যদি ঘর থেকে বের হওয়া না যায়, সে ক্ষেত্রে ইটের গাঁথুনি দেওয়া পাকা ঘর হলে ঘরের কোণে এবং কলাম ও বিমের তৈরি ভবন হলে কলামের গোড়ায় আশ্রয় নিন।
- আধাপাকা বা টিন দিয়ে তৈরি ঘর থেকে বের হতে না পারলে শক্ত খাট বা চৌকির নিচে আশ্রয় নিন।
- ভূমিকম্প রাতে হলে কিংবা দ্রুত বের হতে না পারলে সজাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় নিন ঘরের কোণে, কলামের গোড়ায় অথবা শক্ত খাট বা টেবিলের নিচে।
- গাড়িতে থাকলে যথাসম্ভব নিরাপদ স্থানে থাকুন। কখনো সেতুর ওপর গাড়ি থামাবেন না।
- এ সময় লিফট ব্যবহার করবেন না।
- যদি বহুতল বাড়ির ওপরের দিকে কোনো তলায় আটকা পড়েন, বেরিয়ে আসার কোনো পথই না থাকে, তবে সাহস হারাবেন না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। ভেবে দেখুন, উদ্ধারকারী পর্যন্ত আপনার চিৎকার পৌঁছাবে কি না।
- বিম, দেয়াল, কংক্রিটের ছাদ ইত্যাদির মধ্যে আপনার শরীরের কোনো অংশ চাপা পড়লে, বের হওয়ার সুযোগ যদি নাই থাকে, তবে বেশি নড়াচড়া করবেন না। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।
- ধ্বংসস্তূপে আটকে গেলে সাহস হারাবেন না। যেকোনো উত্তেজনা ও ভয় আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ