দেশে প্রথমবারের মতো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন এমন অন্তত দুজনের শরীরে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ শনাক্ত হয়েছে। বিরল ছত্রাকজনিত এই রোগটি সম্প্রতি সময়ে ভারতে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশে এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে দুজন আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা গেল। এদিকে, তিনদিন আগে এক করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে, যার কারণ ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বলে সন্দেহ করছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে। এমনকি গত রবিবার চিকিৎসার গাইডলাইন দে’য়া হবে জানালেও কোন প্রকার গাইডলাইনের আগেই দেশে রোগী শনাক্ত হলো। আবারও দূরদর্শিতার অভাব দেখা গেল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
কী বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ?
রাজধানীর একটি হাসপাতালে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত দুজন রোগী চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন।
অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, দেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত হওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনও তথ্য আসেনি।
তাহমিনা শিরীন বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। আইইডিসিআর আজই হাসপাতালে গিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হবে।
এদিকে, বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. লাভলি বাড়ৈ গণমাধ্যমকে জানান, আমাদের ল্যাবে দুজনের শরীরে মিউকরমাইকোসিস শনাক্ত হয়েছে। আমরা তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। বারডেমের ল্যাবরেটরিতে করোনা রোগীর শরীরের এবারই প্রথম রোগটি শনাক্ত হয়।
ডা. লাভলি বাড়ৈ জানান, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে অবস্থা গুরুতর হতে পারে। তাই, তাদের সতর্কভাবে চিকিৎসা দিতে হয়।
হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, ৮ মে ৪৫ বছর বয়সী এক রোগীর শরীরে মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়।
এরপর ২৩ মে ৬০ বছর বয়সী আরেকজনের শরীরেও ছাত্রাকজনিত রোগটি শনাক্ত হয়। তারা দুজনই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পরে তারা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হন।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সন্দেহে একজনের মৃত্যু
তিন দিন আগে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সী একজন রোগীর মৃত্যু হয়। ধারণা করা হচ্ছে তিনি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত ছিলেন।
আজ মঙ্গলবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেছে, ওই রোগী অন্যান্য রোগের পাশাপাশি মিউকোরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
এদিকে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত একজন রোগী এখনো বারডেম হাসপাতালে ভর্তি আছেন। শনাক্ত হওয়া আরেকজন রোগী অন্য হাসপাতালে চলে গেছেন।
অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেন বলেন, তিন দিন আগে তার মৃত্যু হয়েছে। এই রোগীর অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস ছিল। তার কিডনির সমস্যা ছিল। তিনি কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছিলেন। চিকিৎসার সময় বোঝা যায়নি যে তিনি মিউকোরমাইকোসিসে আক্রান্ত ছিলেন। মৃত্যুর পর এটা সন্দেহ করা হচ্ছে।
যেভাবে ছড়ায়, উপসর্গ এবং তীব্রতা
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছত্রাক জাতীয় এক রোগ, যা প্রধানত কোভিড রোগীদের মধ্যে ছড়াচ্ছে। মাত্রা ছাড়া স্টেরয়েড নিলে, বেশি দিন হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকলে অথবা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের এই ছত্রাকের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
এছাড়া, শাকসবজি, মাটি, ফল, একই মাস্ক প্রতিদিন পরা থেকে এই রোগ ছড়ায় বলে সতর্ক করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, যারা করোনায় সংক্রমিত হন, তাদের সুস্থ করতে স্টেরয়েড চিকিৎসার সঙ্গে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের যোগসূত্র রয়েছে।
যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের এই ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার ১২ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে এর সংক্রমণ দেখা দেয়।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের উপসর্গ হলো জ্বর, মাথাব্যথা, নাক ও চোখ লাল হয়ে যাওয়া, দৃষ্টি কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, রক্তবমি ইত্যাদি। সাইনাস, মস্তিষ্ক আর ফুসফুসে মূলত ছড়ায় ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ।
তবে কিছু ক্ষেত্রে খাদ্যনালী, চামড়া এবং অন্যান্য অঙ্গেও এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। নাকের উপরে কালো ছোপ, দেখতে অসুবিধা হওয়া, নাক বন্ধ, সর্দি সবই এই রোগের লক্ষণ।
সঙ্গে নাক দিয়ে কালচে কফ বের হয়। নাকের ভিতরের অংশ কালচে রঙের হয়ে যায়। মুখ ও গালে ব্যথা। কারও কারও ক্ষেত্রে সে সব অংশ অবশ হয়ে যায়। সংক্রমণ বেশি ছড়ালে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্টও দেখা দিতে পারে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাকে সংক্রমিত প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ মারা যাচ্ছে। আর যারা বেঁচে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে একটি অংশের চোখ অপসারণ করতে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা না করতে পারলে ৫০-৮০ ভাগ রোগী মৃত্যুবরণ করে থাকে। আর অভ্যন্তরীণ সংক্রমণের মৃত্যুর হার ১০০ ভাগের কাছাকাছি।
কাদের ক্ষেত্রে ভয়াবহ এই ফাঙ্গাস?
এদিকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সম্ভাব্য সংক্রমণ প্রতিরোধ, ব্যবস্থাপনাসহ এই রোগের চিকিৎসায় সামগ্রিক বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সর্বব্যাপী- মাটি, পানি ও বাতাসে ছড়িয়ে থাকলেও সংক্রমণ ক্ষমতা এতই কম যে এক লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র এক-দুই জনের দেহে এই জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে।
কোনো কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেই কেবল এই সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যেটা লাখে ২০ থেকে ৩০ জন হতে পারে।
শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগী, বিশেষত কিটো অ্যাসিডোসিস আক্রান্তরা উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। তাছাড়া ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী, অতিরিক্ত ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, গর্ভবতী নারী, অত্যধিক স্টেরয়েড গ্রহণ করা, কিডনি বা অন্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা রোগী এবং চরম অপুষ্টিজনিত রোগীদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ হতে পারে। চামড়ার গভীর ক্ষত ও পোড়া ঘায়েও এই রোগ হতে দেখা যায়।
কীভাবে এড়াবেন এই ফাঙ্গাস?
ভারতে মিউকরমাইকোসিস বা ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশটিতে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৮০০ জন এই ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ভারতের তামিলনাড়ু, গুজরাট, ওডিশা, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানা- এই পাঁচ রাজ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞের মতে, এই জাতীয় ছত্রাকের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সবারই কিছু সাধারণ নিয়ম মনে চলা উচিত। সাধারণ কয়েকটি নিয়ম মানলেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
দিনে ২ বার ভালো করে দাঁত মাজা, ২ বার মাউথওয়াশ দিয়ে কুলকুচি করা, আর মুখের ভিতর যাতে শুকিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। মুখ শুকিয়ে গেলেই অল্প করে পানি খেতে হবে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদেরকে অতিরিক্ত সচেতন হতে হবে।
এখনও দে’য়া হয়নি চিকিৎসার গাইডলাইন
এদিকে, রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালে অন্তত দুজনের শরীরে এই রোগটি শনাক্ত হয়েছে- এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে। অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, দেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত হওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য আসেনি।
তবে তিনি বলেন, শনাক্ত হলেও আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। শিগগিরই রোগটির চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমরা গাইডলাইন দেব।
এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, দেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস যেন না আসতে পারে, সে বিষয়ে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলাগুলোতে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। এমনকি এই ছত্রাক দেশে এলে চিকিৎসা কেমন হবে, ব্যবস্থাপনা কেমন হবে সে বিষয়েও আনুষ্ঠানিকভাবে সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক (সিডিসি) অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই, বিষয়টি নিয়ে কোভিড–১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি যেটি আছে, তারা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করেছেন। তারাই একটি পরামর্শ চূড়ান্ত করবেন।
তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে আমরা নিজেরা কথা বলেছি। আমরা বিভিন্ন জেলায় সতর্কবার্তা পাঠিয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা কেমন হবে, ব্যবস্থাপনা কেমন হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন আমরা দেব।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫০৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ