ভারতে কোভিডের পাশাপাশি নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ নামক এক ছত্রাক; যার পোশাকি নাম ‘মিউকরমাইকোসিস। এই রোগের ভয়াবহতা যেন হার মানাচ্ছে করোনা মহামারিকেও। যদিও ইতিমধ্যে ভারতে এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে মহামারি ঘোষণা করা হয়েছে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০০ এর অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। চিকিৎসকদের মতে, বিরল এ সংক্রমণে মৃত্যু হার ৫০ শতাংশের মতো। বাঁচার জন্য অনেককে চোখও ফেলে দিতে হচ্ছে।
ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস
ভারতে ভয়ঙ্কর সংক্রামক রোগ ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০০ এর অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। আক্রান্ত মোট রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন। খবর প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মন্দাভিয়ার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক রোগী এখনো চিকিৎসাধীন। সংক্রামক রোগটি নাক, চোখ ও ব্রেইনকে আঘাত করে।
কোন কোন ক্ষেত্রে রোগীরা দুচোখেরই দৃষ্টি হারাচ্ছেন। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়ানো রুখতে চিকিৎসকদের রোগীর চোয়ালের হাড়ও কেটে ফেলে দিতে হয়েছে।
অধিকাংশ রোগীই হয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে তারপর ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছেন অথবা করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার প্রাক্কালে এ রোগে সংক্রমিত হয়েছেন।
চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার ১২ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ দেখা দেয়।
সরকারি তথ্যানুসারে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিল নাড়ু ও রাজস্থানের। কেবল মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে ১ হাজার ৭৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ভয়াবহতা
করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেই ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিসের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দেশটিতে বর্তমানে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষের দেহে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক পাওয়া গেছে।
বিবিসির সূত্র মতে, বিরল এ সংক্রমণে মৃত্যু হার ৫০ শতাংশের মতো। বাঁচার জন্য অনেককে চোখও ফেলে দিতে হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন বেশিরভাগ রোগীই তাদের কাছে পৌঁছচ্ছে দেরিতে। যখন তারা দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছে। এই পর্যায়ে ডাক্তারের অস্ত্রোপচার করে চোখ ফেলে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। কারণ ছত্রাকের মস্তিষ্কে আক্রমণ ঠেকাতে চোখ বাদ দেয়া ছাড় তখন বিকল্প থাকে না।
ভারতের ডাক্তাররা বলছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে রোগীরা দুচোখেরই দৃষ্টি হারাচ্ছেন। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়ানো রুখতে চিকিৎসকদের রোগীর চোয়ালের হাড়ও কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। তবে সেগুলো একেবারে মারাত্মক সংক্রমণের ক্ষেত্রে।
সম্প্রতি কয়েকমাসে ভারতে সুস্থ হয়ে ওঠা কোভিড-১৯ রোগী অথবা যারা সুস্থ হয়ে উঠছেন তাদের মধ্যে কয়েক হাজার ব্যক্তির দেহে এ ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ মিলেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন,এ সংক্রমণের সঙ্গে কোভিড চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেরয়েডের যোগ আছে। কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার ১২-১৮ দিনের মাথায় এ রোগে আঘাত হানার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে মিউকরমাইকোসিসে ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি বলেও মনে করা হচ্ছে।
কাদের জন্য ঝুঁকি বেশি?
মিউকোরমাইকোসিস খুবই বিরল একটা সংক্রমণ। মিউকোর নামে একটি ছত্রাকের সংস্পর্শে এলে এই সংক্রমণ হয়। সাধারণত এই ছত্রাক পাওয়া যায় মাটি, গাছপালা, সার এবং পচন ধরা ফল ও শাকসবজিতে।
এটা মাটি এবং বাতাসে এমনিতেই বিদ্যমান থাকে। এমনকি নাক ও সুস্থ মানুষের শ্লেষ্মার মধ্যেও এটা স্বাভাবিক সময়ে থাকতে পারে। এই ছত্রাক সাইনাস, মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করে।
ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা এইচআইভি/এইডস যাদের আছে; কিংবা কোন রোগের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম এই মিউকোর থেকে তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। এর ওপর কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য যখন স্টেরয়েড দেয়া হয়, তখন সেটা আগুনে ইন্ধন যোগানোর মত হয়ে দাঁড়ায়।
কী ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত রোগীদের সাধারণত যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তার মধ্যে রয়েছে:
- নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নাক থেকে রক্ত পড়া।
- চোখে ব্যথা এবং চোখ ফুলে যাওয়া।
- চোখের পাতা ঝুলে পড়া।
- চোখে ঝাপসা দেখা, যার থেকে পরে দৃষ্টিশক্তি চলে যায়।
- নাকের চামড়ার চারপাশে কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা দেয়া।
ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বন্ধ করার জন্য শিরার মধ্যে ইঞ্জেকশন দেবার ওষুধের দাম ভারতীয় মুদ্রায় এক ডোজ ৩ হাজার ৫০০ রুপি। আর রোগীকে এই ওষুধ দিতে হবে প্রতিদিন আট সপ্তাহ ধরে। এটাই এই রোগের চিকিৎসায় একমাত্র কার্যকর ওষুধ।
কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?
মুম্বাইয়ের ডায়াবেটিসের চিকিৎসক ডা. রাহুল বক্সি বলছেন, এই ছত্রাক সংক্রমণ এড়ানো একমাত্র সম্ভব কোভিড-১৯ এর রোগীর চিকিৎসার সময় এবং তার সুস্থ হয়ে ওঠার সময় যদি নিশ্চিত করা যায় তাকে সঠিক পরিমাণ স্টেরয়েড দেয়া হচ্ছে, সঠিক সময় ধরে।
তিনি বলছেন গত বছর তিনি ৮০০ জন ডায়াবেটিক কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা করেছেন এবং এদের কেউ কোভিড পরবর্তী ছত্রাক সংক্রমণের শিকার হননি। রোগী সুস্থ হবার পর বা হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর তার রক্তে শর্করার মাত্রা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা খুবই জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ভাইরাসের ধরনটা আরও প্রাণঘাতী বলে মনে হচ্ছে। এতে রক্তে শর্করার মাত্রা খুবই বেড়ে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হল আক্রান্ত হচ্ছে অনেক তরুণ।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ