টানা ১১ দিনের রক্ত ঝরানো সংঘাত শেষে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সন্ধি হয়েছে। আর এই যুদ্ধবিরতিকে বিজয় হিসাবেই দেখছেন ফিলিস্তিনবাসী ও এর সমর্থকরা। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধে বরাবরের মতোই ফিলিস্তিনের সমর্থনে ছিল বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার। তবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট পরিবর্তন হয়। যেখানে এতবছর ধরে পাসপোর্টে লেখা ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দদ্বয় তুলে দেওয়া হয়। আর এতে যারপরানই বিস্মিত হয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। এটাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে পুরস্কৃত করা হয়েছে মর্মে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।
গতকাল সোমবার(২৪ মে) সন্ধ্যায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান এসব কথা বলেন।
নিজের কষ্টের জায়গা বর্ণনা করে রাষ্টদূত বলেন, ”কিন্তু এখানে একটা বিষয় আছে, আমি মনে মনে আপনারা সবাই জানেন, এই খবর এমন সময়ে আসল যখন ফিলিস্তিনে বলপ্রয়োগ কেবল থামল এবং আমি মনে করি এটা ঠিক হয়নি। কেননা আমাদের শিশুদের রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি।
তিনি বলেন, “এবং এটা ইসরায়েল এমনভাবে গ্রহণ করেছেন, যেন তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় টুইট করে বলেছে, পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। সুতরাং ইসরায়েলের কাছে সঠিক বার্তা যায়নি, ভুল বার্তা গেছে।”
বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরাইলের প্রতি বিধিনিষেধের কথা উঠিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, এ ঘটনায় আমরা খুশি হতে পারিনি কিন্তু এটা বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত। আমি এটাকে রাজনৈতিকভাবে দেখতে চাই না। বিষয়টিকে বাংলাদেশের সরকারকে আবারো বিবেচনার অনুরোধ জানান রামাদান।
তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের সংকটে বাংলাদেশের মানুষের এমন অভূতপূর্ব সাড়া পেয়ে আমরা সত্যি অবাক। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি প্রত্যেকটি মানুষের প্রতি। একইসঙ্গে বাংলাদেশের নতুন পাসপোর্টে পরিবর্তনকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মনে করেন তিনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটা অগ্রহণযোগ্য, নিশ্চিতভাবে অগ্রহণযোগ্য। এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
“কিন্তু শেষ কথা হল, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ, এটাকে আমরা সম্মান করি। যদি আপনি আমি এবং অধিকাংশ ফিলিস্তিনি জনগণের অনুভূতির বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে আমার অনভূতি হচ্ছে এটা অগ্রহণযোগ্য।”
“সার্বভৌম দেশ হিসাবে হিসাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নিতে পারে। আমরা কেবল সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অনুরোধ জানাতে পারি এবং আশা করি তারা তা করবে,” বলেন ফিলিস্তিনি দূত।
গাজায় সাম্প্রতিক ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্টে এই পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে গত দুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। ইরসায়েলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না- সেই প্রশ্নও তোলা হচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে এক বিবৃতিতে সরকার বলেছে, পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েল প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া হলেও বাংলাদেশিদের সে দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ‘বহাল আছে’ এবং বাংলাদেশের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পররাষ্ট্র নীতিতেও কোনো পরিবর্তন আসেনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, পাসপোর্টের ‘আন্তর্জাতিক মান’ রাখতে গিয়েই ওই পরিবর্তন আনা হয়েছে, এর সঙ্গে বাংলাদেশের ইসরায়েল-নীতির কোনো সম্পর্ক নেই।
এর মধ্যেই রোববার ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উপ পরিচালক রাষ্ট্রদূত গিলাড কোহেনের একটি টুইট ওই আলোচনাকে আরও উস্কে দিয়েছিল। সোমবার এক ফেইসবুক পোস্টে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ‘বন্ধু’ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বাগত জানানোর কথা বলা হয়।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রামাদান বলেন, “স্পষ্ট করে বললে, আমি এই খবরকে খুশি বা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করিনি। এই খবর আমি বেদনার সঙ্গে গ্রহণ করেছি।
“যদিও আমি মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, সার্বিক পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য। তিনি নিশ্চিত করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং নাগরিকদের ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আগের মতোই থাকছে। রাজনৈতিকভাবে এটা আমার জন্য যথেষ্ট।”
রামাদান বলেন, “বার্তাটি গেল এমন সময়ে গেল, তখন তারা কেবল অপরাধ সংঘটনের করেছে, নির্মমতা চালিয়েছে এবং আমাদের জনগণ ভোগান্তি সহ্য করেছে। এটা (পাসপোর্টে পরিবর্তন) ঠিক সময়ে হয়নি এবং আমি মনে করি এটা পরেও হতে পারত।”
পরিবর্তনটি পরে কখন হতে পারত, তারও একটি ব্যাখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রদূত রামাদান বলেন, “ইসরায়েল সময়ে সময়ে শান্তি প্রক্রিয়ার দিকে কিছুটা এগোয়, তাদেরকে সে সময় এভাবে পুরস্কৃত করা যেত।
“যখন তারা এসব ঘটনা ঘটাল, যার ভিডিও ফুটেজ আপনারা দেখেছেন, ফিলিস্তিনিরা স্বজন হারালো এবং বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া হলো, এটা পরিবর্তনের ঠিক সময় আমার কাছে মনে হয়নি।”
তিনি বলেন, “আমি আন্তরিকতার সঙ্গে আশা করি সরকার এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে এবং বাক্যটি পাসপোর্টে রাখবে। কেননা এটা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য খুবই খুবই ভালো সমর্থনকে প্রতিনিধিত্ব করে।”
বাংলাদেশের পাসপোর্ট যেন ‘আন্তর্জাতিক মানের’ হয় সেজন্যই এ পরিবর্তন আনা হয়েছে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের উক্ত বক্তব্যের বিষয়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আপনি কি বলছেন যে গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশি পাসপোর্ট আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখেনি। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশ যারা পাসপোর্টে ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা উল্লেখ করছে তাদের পাসপোর্ট কি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়?’
পাসপোর্টের এই পরিবর্তন নিয়ে রাষ্ট্রদূত দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে আলোচনা করতে চান বলেও উল্লেখ করেন।
দেশের পাসপোর্টে পরিবর্তনের বিষয়টি কয়েক দিন আগে সামনে আসে। এরপর ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের উপমহাপরিচালক গিলাদ কোহেন গত শনিবার একটি টুইট করেন। তিনি টুইটে লেখেন, ‘দারুণ খবর! ইসরায়েল ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশের সরকারকে তাই ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আহ্বান জানাই। এতে দুই দেশের জনগণ উপকৃত হবে এবং সমৃদ্ধি লাভ হবে।’
এর পরদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই পরিবর্তনে ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পরিবর্তনের কিছু নেই। কারণ, আমরা তো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিই না।’ একই দিন বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ইসরায়েল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে এবং ইসরায়েলের প্রতি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অবস্থানের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।
এদিকে গতকাল তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পাসপোর্টের পরিবর্তন আন্তর্জাতিক রীতির কারণে করা হয়েছে। এতে কোনোভাবেই ইসরায়েলের উল্লসিত হওয়ার কারণ নেই। ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মন্ত্রী আরও বলেন, পাসপোর্টে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, বাংলাদেশিদের জন্য ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষিদ্ধ ও বন্ধই থাকছে। একইভাবে ইসরায়েলি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসাও নিষিদ্ধ থাকবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ