গত দেড় দশকে সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, নার্গিস, মোরা, বুলবুল ও আম্পানসহ একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। একটির ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই ফের নতুন নামে আঘাত হানছে প্রলয়ংকরী সব ঘূর্ণিঝড়।
এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন উপকূলীয় এলাকার মানুষ। একইসঙ্গে বেড়িবাঁধ ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে এলাকাবাসী। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর এক বছর পার হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় শঙ্কিত উপকূলের মানুষ।
জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি, বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলায় নদীর তীর ও বেড়িবাঁধের পাশে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বসবাস। ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো পুনর্বাসন এবং এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান।
দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে খুলনার কয়রা একটি। এ উপজেলার বাসিন্দা নিশীথ রঞ্জন মিস্ত্রি জানান, দুর্যোগকবলিত এ জনপদের মানুষ ভাঙাগড়ার মধ্যেই দিনাতিপাত করছে। একটির ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই ফের নতুন নামে আঘাত হানছে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। এসব ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ। সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো জমি ও সম্পদ হারিয়ে এখন উদ্বাস্তু। ভয়াবহ তাদের জীবনসংগ্রামের চিত্র।
গত বছরের ২০ মে আম্পানের তাণ্ডবে ৬০ এর দশকে উপকূলীয় এলাকায় নির্মিত অনেক বেড়িবাঁধ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে স্থানীয়রা টিকে থাকার স্বার্থে অনেক স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে ও প্রশাসনের সহযোগিতায় রিং বাঁধ দিয়ে কোনোমতে তা সংস্কার করেছিল। এখন ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’র খবরে নতুন করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তারা।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, বেড়িবাঁধ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক রয়েছে। উপজেলার উত্তর বেদকাশি এলাকার গাতিরভেড়ি, মহারাজপুরের মঠবাড়ি, দশালিয়া, মহেশ্বরীপুরের নয়ানি এই চারটি বেড়িবাঁধ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বেড়িবাঁধগুলো সংস্কারে কাজ চলছে। আমি সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। তবে কাজের গতি সন্তোষজনক নয়।
তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। সিপিপি, রেডক্রিসেন্ট, ইউপি সদস্যসহ স্বেচ্ছাসেবীরা প্রস্তুত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। যারা সাগরে বা নদীতে রয়েছে তাদের ফিরে আসতে বলা হয়েছে। নির্দেশনা পাওয়া মাত্র স্থানীয়দের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, পানিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মাটির কণাগুলো একে অপরের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছে, অর্থাৎ ঝুরঝুরে হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভাঙন বাড়ছে, বাঁধগুলো টিকছে না। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অবাধ জোয়ার-ভাটার (টিআরএম) মাধ্যমে ভূমি উঁচু করার সুপারিশ করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেন জানান, নানা কারণে বাঁধগুলোর সক্ষমতা কমেছে। এ অবস্থায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে ৪৮০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য সাতটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন উপকূলের দুর্যোগ ও বিপর্যয় মোকাবেলায় অনেক প্রকৃতিনির্ভর ও লোকায়ত প্রক্রিয়া আগে ছিল। কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেছে, যা খুঁজে বের করাও দরকার। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর জোরালোভাবে উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থার পুনর্বাসনের দাবি ওঠে। যে দাবি মূলত দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। উপকূল এলাকায় দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।
খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ মো. আকতারুজ্জামান বাবু বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর এটি স্পষ্ট যে, দুর্বল বেড়িবাঁধ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূলীয় এলাকার দুর্যোগ বেড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪৪৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ