বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজার লোক নতুন করে কোটিপতি হচ্ছে বলে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
শনিবার রাতে অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত এক ভার্চুয়াল আলোচনায় বর্তমানে দেশের বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন,‘আমার হিসাবে দেশে এখন প্রতিবছর পাঁচ হাজার লোক নতুন করে কোটিপতি হচ্ছে। এতেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য কীভাবে বাড়ছে, আমাদের কতটা নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে, সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে।’
বর্তমানে বাংলাদেশে বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ দিতে গিয়ে ফরাসউদ্দিন উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশে এখন মোট ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে ৪৩ হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হিসাবে আছে মোট আমানতের ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ মোট আমানতের অর্ধেকই আছে এই ৪৩ হাজার মানুষের কাছে। বাকি ১ কোটি ১৯ লাখ ৫৭ হাজার ব্যাংক গ্রাহকের হাতে আছে বাকি অর্ধেক আমানত।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাতের সদ্য প্রকাশিত বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে গবেষণাগ্রন্থটির ওপর এক ওয়েবিনার আলোচনায় ফরাসউদ্দিন এই তথ্য দেন। তিনি বলেন, ‘বৈষম্যর সবচেয়ে খারাপতর রূপ হলো সুযোগের বৈষম্য। বাংলাদেশে আড়াই কোটি মানুষ কর দেয়ার যোগ্য; কিন্তু কর দেন ২৫ লাখ মানুষ।
মহামারি করোনাভাইরাসের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের সমালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধাভোগী সম্পর্কে সরকারের কতটুকু নজর আছে, এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। ২৫ লাখ ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা দিতে ব্যাংকের ম্যানেজাররা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তারা চেনাজানা লোকজনদেরই ঋণ দিতে ইচ্ছুক।’
এই সমস্যা সমাধানে বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে। প্রয়োজনে এসব উদ্যোক্তাকে ১ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হবে এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডের আশ্রয় নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ বেড়ে গত জানুয়ারিতে ১২ লাখ ৮৬ হাজার ২০১ কোটি টাকায় উঠেছে। এত বিপুল আমানত আগে কখনও দেখা যায়নি।
এই ওয়েবিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকনেজ স্টেট ইউনির্ভাসিটির অধ্যাপক ড. এ কে এম মতিউর রহমান এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন অর্থনীতি সমিতির সহসভাপতি এ জেড এম সালেহ।
মতিউর রহমান বলেন, পরিবেশকে উপেক্ষা করে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হলে সে উন্নয়ন টেকসই উন্নয়ন হবে না। শোভন সমাজের জন্য শোভন মানুষ লাগবে। মাথাপিছু আয় কখনও সমান হবে না, কিন্তু আয় বৈষম্য কীভাবে কমানো যায় এবং আয় বৈষম্য যেন লাগামহীন না হয়, সেই লক্ষ্যে সরকারকে নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, বিশ্বব্যবস্থায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বিশ্বের নিরাপত্তা বিধানের প্রধান দায়িত্ব যে বৃহৎ শক্তিগুলোর, তারাই মানুষের ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানোর কাজটি করছে। বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্রের জন্য যে পরিমাণ ব্যয় করা হয়, তার ১ শতাংশ টাকাও মানুষের জন্য ব্যয় করা হয় না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধনিক শ্রেণির বৃদ্ধির হার বিশ্বে সর্বোচ্চ, একই সাথে পরিবেশ দূষণের হারও সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে বৃহৎ প্রকল্পগুলোর নির্মাণব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ; কারণ এর মধ্যে আছে ভয়াবহ দুর্নীতি, যেটা সম্ভব হয় জবাবদিহির অভাবে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান শোভন সমাজ গড়তে হলে বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রাণবিনাশী বা ভুল প্রকল্পে (রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর, মাতারবাড়ি) অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করতে হবে। কারণ, এগুলো মানুষের দারিদ্র্য বৃদ্ধি করছে।
ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে ১৮ জন কালোটাকা, অর্থ পাচার, সম্পদ, কর ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেন। আলোচকরা তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাতের ২০ বছরের গবেষণার ফসল এ বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা।
৭৩৬ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি সম্পর্কে অভিনন্দনবাণী দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি। কৃতজ্ঞতাপত্র, মুখবন্ধ ও মোট ১২টি অধ্যায় ছাড়াও বইটিতে আছে ২৭টি সারণি, ৩৯টি লেখচিত্র, তথ্যপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট।
এই গ্রন্থটি নিয়ে আরও চারটি ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ