টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর করোনাভাইরাসে কেউ কেউ আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে তেমন কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সাইয়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) একদল গবেষক। করোনাভাইরাসের টিকা নেয়া ব্যক্তিরা আক্রান্ত হলেও তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক কম বলে এক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে।
সম্প্রতি সিভাসু’র উপাচার্য প্রফেসর ড. গৌতম বুদ্ধ দাশের নেতৃত্বে একদল গবেষক অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণকারী কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। সিভাসু উপাচার্য অধ্যাপক গৌতম বুদ্ধ দাশের নেতৃত্বে সাত সদস্যের গবেষক দল গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রথম ডোজের টিকাগ্রহীতাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে এ গবেষণা কার্যক্রম চালান।
তবে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক ভিত্তিতে গবেষণা না হলে এ বিষয়ে সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠবে না বলে তারা আরও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করছেন।
গবেষণা দলের অন্য সদস্যরা হলেন সিভাসুর অধ্যাপক ড. শারমিন চৌধুরী ও ডা. ইফতেখার আহমেদ রানা, ভেটেরিনারি চিকিৎসক ত্রিদীপ দাশ, প্রনেশ দত্ত, মো. সিরাজুল ইসলাম ও তানভীর আহমদ নিজামী।
গবেষণায় ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সিভাসু ল্যাবে পরীক্ষা করা ছয় হাজার ১৪৬ জনের নমুনার মধ্যে কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়া এক হাজার ৭৫২ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। এই ব্যক্তিদের মধ্যে ২০০ জন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড-এর প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, টিকা নেয়ার পর আক্রান্তদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতে হয়নি। টিকা নেওয়ার পর আক্রান্ত ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও তাদের মধ্যে কোনো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি পরিলক্ষিত হয়নি।
টিকা নেওয়ার পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ২০০ রোগীর ওপর চালানো গবেষণায় দেখা যায়, তাদের মধ্যে ৮৮ শতাংশের বেশি রোগীর শ্বাসকষ্ট ছিল না। ৯২ শতাংশ রোগীর অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়নি।
বয়স্ক ও কো-মরবিডিটির কারণে কিছুসংখ্যক রোগীর শ্বাসকষ্ট ও অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়েছে। টিকার প্রথম ডোজ নেওয়া পর আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজন রোগীর।
গবেষণায় দেখা গেছে, আক্রান্তদের অধিকাংশ টিকা নেওয়ার অন্তত ৩২ দিন পর আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের শরীরের গড় তাপমাত্রা ছিল ১০১ ডিগ্রি। লিঙ্গ ও বয়সভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৯৯ ডিগ্রি থেকে ১০৪ ডিগ্রি।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক গৌতম বুদ্ধ দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজের কার্যকারিতা কতটুকু তা বুঝতে এ গবেষণা চালানো হয়।
তিনি বলেন, টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর আক্রান্ত ২০০ জনের মধ্যে ১৬৫ জনের মৃদু উপসর্গ ছিল এবং ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে তাদের নমুনা পরীক্ষায় ‘নেগেটিভ’ ফল এসেছে।
এদের মধ্যে ১২৯ জনের (৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ) কো-মরবিডিটি ছিল, এর মধ্যে ৩৫ জন হাসপাতালে গেছেন, তাদের ১৬ জনের অক্সিজেন লেগেছে, কিন্তু তাদের তীব্র স্বাস্থ্য ঝুঁকি হয় নাই। এই ১২৯ জনের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ (৩৬ জন), ডায়াবেটিস (৩২ জন), এলার্জির (পাঁচজন) সমস্যা ছিল । ৫১ জনের আবার একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল।
টিকাগ্রহীতাদের মধ্যে শুধু একজন রোগী হাসপাতালে মারা গেছেন উল্লেখ করে সিভাসু উপাচার্য বলেন, “৪৮ বছর বয়সী ওই রোগীর পূর্বেই কিডনি নিয়ে জটিলতা (কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট) ছিল বলে আমরা জেনেছি। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে আক্রান্ত হলেও স্বাস্থ্য ও মৃত্যু ঝুঁকি কম হবে বলে আমাদের মনে হয়েছে।”
সিভাসুর প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক শারমিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা গ্রহণকারী আক্রান্তদের সঙ্গে টিকা না নিয়ে আক্রান্তদের কয়েকজনের সঙ্গে আমরা তুলনা করেছি। টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণকারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা তুলনামূলক অনেক কম ছিল। তারা অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত ছিলেন।’
এ গবেষণা সম্পর্কে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, গবেষণাটি অবশ্যই ইতিবাচক। এটা আরও বড় পরিসরেও হতে পারে। এতে টিকায় মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, ‘এমনিতে আমরা যেসব রোগী পাচ্ছি, তাতে দেখা যায় টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে করোনা হলেও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কম দেখা দিচ্ছে। টিকার দ্বিতীয় ডোজও সবাইকে নিতে হবে।’
এদিকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনের মধ্যেই এক দিনে ১ লাখ ৭০ হাজার ৯০২ জন করোনাভাইরাসের টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট ১৬ লাখ ৭৮ হাজার ১৮৯ জনকে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে, যা প্রথম ডোজ পাওয়া নাগরিকের সংখ্যার ২৯ শতাংশের সামান্য বেশি। এ পর্যন্ত টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন মোট ৫৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮৫ জন।
গত ৮ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় ডোজের পাশাপাশি টিকার প্রথম ডোজও দেওয়া হচ্ছে; তবে সে সংখ্যা কিছুটা কমেছে। মঙ্গলবার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১৫ হাজার ৯৩৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, দুই ডোজ মিলিয়ে এ পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়েছে মোট ৭৪ লাখ ২৩ হাজার ২৭৪ ডোজ। আর মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন ৭১ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৩ জন।
বাংলাদেশে দেওয়া হচ্ছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড। এই টিকার দুটি ডোজ নিতে হয়।
প্রথম কয়েকদিন পরীক্ষামূলক দেওয়ার পর দেশজুড়ে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া শুরু হয় ফেব্রুয়ারিতে। দুই মাস পর ৮ এপ্রিল শুরু হয় দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ