ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার তদন্ত করে জাতিসংঘের বিদায়ী তদন্ত কর্মকর্তা অ্যাগনেস কল্যামার্ড তার তদন্ত প্রতিবেদনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দায়ী করেছিলেন। এর জেরেই অ্যাগনেস ক্যালামার্ডকে দুইবার হত্যার হুমকি দিয়েছেন সৌদি আরবের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ক্যালামার্ড এমন অভিযোগ করেন।
অ্যাগনেস ক্যালামার্ড একজন স্বাধীন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ। চলতি মাসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব পদে যোগ দিতে যাচ্ছেন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সের নাগরিক ক্যালামার্ড। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে জামাল খাসোগিকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনি তদন্ত করেন।
এর এক বছর পর তিনি ১০০ পাতার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যাতে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও দেশটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা রয়েছেন বলে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকার কথা জানিয়েছেন। ওই হত্যাকাণ্ডকে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ হিসেবেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন ক্যালামার্ড।
দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ক্যালামার্ড বলেন, জাতিসংঘের একজন সহকর্মী তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সৌদি আরবের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
জেনেভায় জাতিসংঘের অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠককালে এই হুমকি দেওয়া হয়। এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তারা বলেন, যদি জাতিসংঘ তাকে (ক্যালামার্ড) না থামায়, তবে তাকে দেখে নেওয়া হবে।
ক্যালামার্ড বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘের এক সহকর্মী তাকে সতর্ক করে বলেছিলেন, জেনেভায় সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌদি আরবের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। সেখানে জ্যেষ্ঠ ওই কর্মকর্তা ক্যালামার্ডকে দুইবার হুমকির কথা জানান। তিনি (সৌদির কর্মকর্তা) বলেছিলেন, জাতিসংঘ ক্যালামার্ডকে নিয়ন্ত্রণ না করলে তারাই ব্যবস্থা নেবেন।
বৈঠকে উপস্থিত ওই সহকর্মী সৌদি কর্মকর্তার হুমকিকে কীভাবে নিয়েছিলেন জানতে চাইলে ক্যালামার্ড বলেন, ‘ওটা মৃত্যুর হুমকি ছিল। তিনি আমাকে তা-ই জানিয়েছেন।’
খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এই মানবাধিকারকর্মীর কাজের ব্যাপক সমালোচনা করেছেন সৌদি কর্মকর্তারা।
জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সফররত সৌদি কর্মকর্তা ও জেনেভা ভিত্তিক সৌদি কূটনীতিকদের বৈঠকে তাকে হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি তার কাজ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
সহকর্মীর বরাত দিয়ে ক্যালামার্ড বলেন, ‘গত বছরের জানুয়ারিতে জেনেভা ভিত্তিক সৌদি কূটনীতিকদের সঙ্গে শহরটিতে সফররত সৌদি কর্মকর্তা ও জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। বৈঠকের একপর্যায়ে খাসোগি হত্যা নিয়ে আমার তদন্ত প্রতিবেদনের সমালোচনা করেন সৌদি কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা ক্ষোভ প্রকাশও করেন। কাতার থেকে টাকা খেয়ে ওই প্রতিবেদন করা হয়েছে বলে আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগও আনেন তারা।’
‘এরপর সফররত সৌদি আরবের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, কয়েকজন ব্যক্তি ক্যালামার্ডকে শিক্ষা দিতে প্রস্তুত। বিষয়টি ওইসব ব্যক্তি তাকে ফোন করে জানিয়েছেন।’
গত মাসের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন সরকার খাসোগি হত্যার অপ্রকাশিত প্রতিবেদন জনসমক্ষে নিয়ে আসে। এতে বলা হয়, খাসোগিকে আটক কিংবা হত্যার একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেন সৌদি যুবরাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে আটক বা হত্যা করতে ইস্তাম্বুলে একটি অভিযান অনুমোদন করেছিলেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামাল খাসোগিকে নিজ সাম্রাজ্যের প্রতি হুমকি হিসেবেই দেখতেন যুবরাজ সালমান। এমনকি খাসোগিকে চুপ করাতে প্রয়োজন মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতেও সম্মতি ছিল তার।
তবে এ অভিযোগ বরাবরের মতো অস্বীকার করেছে সৌদি রাজ পরিবার বা যুবরাজ সালমান। খাসোগিকে হত্যায় সৌদি যুবরাজকে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ‘মিথ্যা’ বলা হয়েছে।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, রাজ্যের নেতৃত্ব সম্পর্কিত নেতিবাচক, মিথ্যা এবং অগ্রহণযোগ্য মূল্যায়ণ সৌদি সরকার পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। বিবৃতিতে এই প্রতিবেদনে ভুল তথ্য সংযোগ এবং অনুমাননির্ভর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুপরিচিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি সৌদি আরবের বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার হয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত অভিযান এবং আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের উত্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কাভার করেন। ৫৯ বছর বয়সী জামাল খাসোগি বেশ কয়েক দশক সৌদি রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং সৌদি সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১৭ সাল থেকে তিনি আমেরিকায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। সেসময় থেকেই তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কার্যক্রম সমালোচনা করে প্রতি মাসে কলাম লিখতেন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তার প্রথম কলামে তিনি যুবরাজের বিরোধিতা করার জন্য গ্রেপ্তার হতে পারেন বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের পর নিখোঁজ হন তিনি।
পুলিশের ধারণা, ৫৯ বছর বয়সী সাংবাদিক খাসোগিকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর তার মরদেহ টুকরো করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সৌদি সরকার বরাবরই এ হত্যাকাণ্ডে যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ