যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক গত সপ্তাহে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন, কিন্তু উত্তর কোরিয়া তাতে কোনো সাড়াই দিচ্ছে না। এরইমধ্যে স্বল্পপাল্লার দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে উত্তর কোরিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর এই প্রথম প্রকাশ্যে অস্ত্র পরীক্ষা চালাল উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের এই খবরে বাইডেন খুবই উত্তেজিত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার স্বল্প পরিসরের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কখনই মেনে নেবেন না তিনি। অবশ্য এটা ‘নতুন কিছু না’, ‘উস্কানিমূলকও নয়’, প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা এটাকে ‘যথারীতি ব্যবসা’ বলছেন বলেও জানিয়েছেন বাইডেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ (জেসিএস) আজ বুধবার জানিয়েছে, স্থানীয় সময় রোববার সকালের দিকে এ ক্ষেপণাস্ত্র দুটি ছোড়া হয়।
বুধবার জেসিএসের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, উত্তর কোরিয়া যে শিগগিরই একটি অস্ত্র পরীক্ষা চালাতে যাচ্ছে সিউল সে সংক্রান্ত ইঙ্গিতগুলো শনাক্ত করতে পেরেছিল এবং সার্বক্ষণিক নজর রাখছিল।
উত্তর কোরিয়ার অত্যাধুনিক অস্ত্র যেমন পারমাণবিক বোমা বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষার বিষয়টি জেসিএস প্রায় কাছাকাছি সময়ে জানাতে পারলেও তুলনামূলক কম অত্যাধুনিক বা স্বল্প পাল্লার কিছু অস্ত্রের পরীক্ষার ব্যাপারে তেমনটা করে না।
মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার উত্তর কোরিয়ার স্বল্পমাত্রার দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার বিষয়টি জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন বলছে, সেনাবাহিনীর নিয়মিত পরীক্ষার অংশ হিসেবে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। উত্তর কোরিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিয়মের বাইরে যায়নি বলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
মার্কিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরীক্ষাটি ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত ছিল। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই তারা ধারণা করেছিলেন যে, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন এই অঞ্চলে তার দেশের গুরুত্ব সম্পর্কে বাইডেন প্রশাসনের কাছে একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করবেন।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, উত্তর কোরিয়া কোনো ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়নি। তারা স্বল্প-পরিসরের সম্ভবত আর্টিলারি বা ক্রুজ মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়েছে।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, বাইডেন প্রশাসনকে উত্তর কোরিয়া বোঝাতে চেয়েছে যে, তারা গুরুতর সীমা লঙ্ঘন করেনি এবং এটি পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক আলোচনার আগ্রহের বিষয়ে বাধা হবে না।
মঙ্গলবার একজন সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘গত সপ্তাহে ঘটে যাওয়া তৎপরতায় উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির ভবিষ্যতের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন না। এখনো আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে বৈঠকও করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু সিঙ্গাপুরে হওয়া সে বৈঠকে বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি।
পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার পাশাপাশি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ জারি রেখেছে পূর্ব এশিয়ার দেশটি।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে জানানো হয়, সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ঘটনায় পিয়ংইয়ংকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।
বাইডেন প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ দুই কর্মকর্তা ব্রিফিংয়ে অভিযোগ করেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়া সক্রিয়ভাবে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য দুই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, উত্তর কোরিয়া একটি নয়, দুটি স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তারা।
এ মাসের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী যৌথ কুচকাওয়াজ করে। টোকিও ও সিউলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন কয়েক দিন আগে সফর করেছেন। এরপরই সরকারি টিভিতে কোনো ঘোষণা না দিয়ে পিয়ংইয়ং ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ল।
মার্কিন কর্মকর্তাদের সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের ঘুম নষ্ট করে দেবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের বোন। পিয়ংইয়ংয়ের সরকারি পত্রিকা ‘রডং সিনমুন’-এর খবরে জানানো হয়, উনের বোন ওই বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের উদ্দেশে বলেন, ‘তারা আমাদের মাটিতে বারুদের গন্ধ ছড়ানোর চেষ্টা করছে।’
চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে উত্তর কোরিয়া সীমান্ত বন্ধ রেখেছে। গত জানুয়ারিতে বাইডেনের অভিষেকের আগে কিম জং-উন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন। ওই মাসেই সামরিক কুচকাওয়াজে পিয়ংইয়ং সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপ করা যায় এমন নতুন ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শনী করে। তবে বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ল উত্তর কোরিয়া।
পেন্টাগন উত্তর কোরিয়ার এবারের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। জাতিসংঘের উত্তর কোরীয় মিশনের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের দিক থেকেও সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, উত্তর কোরিয়ার এবারের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা সম্ভবত চলতি মাসে হয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ মহড়ারই প্রতিক্রিয়া। উত্তরের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরুর চেষ্টায় এবার দুই দেশের মহড়াটি সীমিত পর্যায়ে হয়েছে।
উত্তর কোরিয়া চলতি মাসের এই যৌথ মহড়ার কড়া সমালোচনা করেছে। দেশটি ২০১৭ সালের পর কোনো পারমাণবিক অস্ত্র বা আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়নি।
তবে ২০১৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তরের শীর্ষ নেতা কিম জং উনের মধ্যে ভিয়েতনামের হ্যানয়ে হওয়া ব্যর্থ শীর্ষ সম্মেলনের পর থেকে পিয়ংইয়ং ধারাবাহিকভাবে স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে গেছে। ট্রাম্প প্রশাসনও এ ধরনের পরীক্ষাগুলোকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি।
অস্ত্র পরীক্ষার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে উত্তর কোরিয়া তুলনামূলকভাবে নীরব রয়েছে। এর আগে দেশটির সামরিক ক্ষমতা বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরোধের ক্ষমতা নিয়ে কথা বললেও এখন সেটি থেকে বিরত আছে।
অন্যদিকে, আমেরিকার আঞ্চলিক মিত্র দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানও একইভাবে নীরব আছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার আইনপ্রণেতা হা তায়ে-কেউং এক ফেসবুক পোস্টে জানান, অতীতে যেমন ছিল তেমনভাবে এ উৎক্ষেপন নিয়ে ঘোষণা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৬১১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ