করোনার কারণে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির একটি হিসাব প্রণয়ন করেছে সরকার। গত এক অর্থবছরে (২০১৯-২০) এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা, যা কি না সে বছরের জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব প্রণয়ন করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে করোনার ধাক্কা সামলানোর জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা সামলে উঠতে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের নিম্ন-আয়ের তরুণ জনগোষ্ঠী ও বিদেশফেরত প্রবাসী কর্মীদের সহায়তার জন্য এ ঋণ অনুমোদন করে বিশ্বব্যাংক। গতকাল বুধবার(১৭ মার্চ) ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় এ ঋণ প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের শিগগিরই চুক্তি সই হবে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
করোনায় বাংলাদেশের ক্ষতি ৮৪ হাজার কোটি টাকা
অর্থ বিভাগের করা ‘কোভিড-১৯ অভিঘাত ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘করোনাভাইরাস দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। ফলে প্রাণহানিসহ ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ’
কোভিড মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত কী করা হয়েছে তা একটি বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘কোভিড-১৯ জনিত অভিঘাত মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী ৪টি নীতি কৌশল অবলম্বন করেন। পরবর্তীতে এরই আলোকে পর্যায়ক্রমে ২৩টি অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা (১৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের সমান এবং জিডিপির ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ)। ’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ‘বিগত ১২ বছর দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকায়, প্রণোদনা প্যাকেজগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতি স্বল্প সময়ে কোভিড-পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, কোভিডের কারণে দেশে অর্থনীতির ওপর কী বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে আমরা কাজ করেছি। এ ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সহায়তা নিয়েছি। যে অর্থবছর নিয়ে আমরা কাজ করেছি সেটি হলো ২০১৯-২০ অর্থবছর। এ সময় টানা তিন মাস দেশের শিল্পকারখানা-অফিস-আদালতসহ সব কিছু লকডাউন বা বন্ধ ছিল।
হিসাব প্রাক্কলনের সময় আমরা দেখেছি, ওই অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির আকার ধরা হয়েছিল স্থির মূল্যে ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু পরবর্তীতে কোভিডের কারণে জিডিপি আকার সংশোধন করে তা ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এর সাথে প্রবৃদ্ধি হার ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ কমিয়ে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ করা হয়েছে। টাকার অঙ্কে জিডিপি কমেছে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা। এটিকেই আমরা কোভিডের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হিসেবে মনে করছি।
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত করোনার কারণে দেশের অর্থনীতি কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণের কাজ চলমান রয়েছে। আগামী জুন মাসের আগেই এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। সে সময় আমরা খাত ভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব দিতে সমর্থ হবো।
এ দিকে করোনার কারণে যে ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ও বাস্তায়ন করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—
প্যাকেজ-১: ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেয়া হয়। এতে ব্যাংকব্যস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধা প্রণয়নের ঘোষণা দেয়া হয়। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেয়া হয়।
এ ঋণসুবিধার সুদের হার হচ্ছে ৯ শতাংশ। ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বহন করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে প্রদান করবে।
প্যাকেজ-২: ক্ষুদ্র-কুটিরশিল্প ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান- ব্যাংকব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধা দেয়া হয়। ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে।
এ ঋণসুবিধার সুদের হারও হচ্ছে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
প্যাকেজ-৩: বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানো: ব্যাক- টু- ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানিসুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়। ফলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। ইডিএফের বর্তমান সুদের হার লাইবর + ১.৫ শতাংশ (যা প্রকৃত পক্ষে ২.৭৩ %) থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।
প্যাকেজ-৪: প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণসুবিধা চালু করছে। এ ঋণসুবিধার সুদের হার হচ্ছে ৭ শতাংশ।
প্যাকেজ-৫: এর আগে রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ করার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পরে এই প্যাকেজের আওতা আরো বেড়ে যায়। এটির আওতায় ৮০ ভাগ রফতানিমুখী গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকদের ৫ মাসের বেতন প্রদান করা হয়।
বিশ্বব্যাংকের ১৭০০ কোটি টাকা ঋণ
এদিকে গতকাল বুধবার বিশ্বব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা সামলে উঠতে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের নিম্ন-আয়ের তরুণ জনগোষ্ঠী ও বিদেশফেরত প্রবাসী কর্মীদের সহায়তার জন্য ২০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা।মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এই গোষ্ঠীর আয়ের সুযোগ বাড়াতে ও ধকল সামলে উঠতে এ তহবিল ব্যয় করতে পারবে সরকার।
বিশ্বব্যাংক বলছে, এ প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ক্ষুদ্র যুব উদ্যোক্তাকে সহায়তা দেয়া হবে। কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাদের কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, যাতে সবাই আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারেন। এসব সেবা দিতে ৩২ জেলায় কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। করোনার প্রাদুর্ভাবে বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এ প্রকল্পের আওতায় তাদেরও সহায়তা দেয়া হবে।
অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান, পুনরুদ্ধার এবং অগ্রগতিবিষয়ক বা রেইসি প্রকল্পের আওতায় সহজ শর্তে এ ঋণ দেয়া হবে। পাঁচ বছর গ্রেস সময়সীমাসহ ৩০ বছরে বাংলাদেশ সরকারকে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে পাঁচ বছর শুধু ঋণের মূল টাকা পরিশোধ করতে হবে। তারপর থেকে সুদ ও আসল দিতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয় দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষানবিশ কর্মসূচি, পরামর্শ, ক্ষুদ্রঋণ ও স্বকর্মসংস্থান সহায়তার মতো সেবাগুলো পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টিতে কাজ করবে প্রকল্পটি। ২০২০ সালের জানুয়ারির পর মহামারির কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়া দুই লাখ প্রবাসী কর্মীকে দেশে বা বিদেশে আবার কাজের সুযোগ করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও সহায়তা দেওয়া হবে। প্রকল্পের আওতায় সেবা দিতে দেশের ৩২টি জেলায় জনকল্যাণ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হবে এসব কেন্দ্রে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি মিয়াং টেমবুন বলেন, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও শহরের অনানুষ্ঠানিক খাতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এ দুটি খাতই ক্ষতিগ্রস্ত। প্রকল্পটি এ দুই গোষ্ঠীর কর্মীদেরই নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে যেতে সহায়তা দেবে।
প্রকল্পের দলনেতা ও বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সৈয়দ আমের আহমেদ বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়া প্রবাসী কর্মীদের জন্য তাৎক্ষণিক চাহিদাগুলো পূরণের লক্ষ্য রাখা হয়েছে এ প্রকল্পে। দীর্ঘমেয়াদে যাতে তারা এ ধকল সামলে ওঠার সুফল পেতে পারেন সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। নারী প্রবাসী কর্মীরাও, বিশেষত যারা লৈঙ্গিক বৈষম্যের শিকার, তারা এই প্রকল্পের আওতায় সেবা নিতে পারবেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১০৩৭
আপনার মতামত জানানঃ