করোনা মহামারির কারণে গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর সময়ে ৬২ শতাংশ কর্মজীবী বা শ্রমিকের বেতন বা মজুরি কমে যায়। তাদের ২৭ দশমিক ৮০ শতাংশের বেতন এখন করোনার পূর্ব অবস্থায় ফিরেছে। অন্যদিকে ৩৪ দশমিক ২০ শতাংশ শ্রমিকের মজুরি আগের অবস্থায় ফেরেনি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম পরিচালিত ‘কর্মসংস্থান ও অভিবাসনের ওপর মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার (১০ মার্চ) এক ওয়েবিনারে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত ৬৯ শতাংশ, নির্মাণ খাতে ৭৪ শতাংশ এবং পরিবহন খাতের ৮০ শতাংশ শ্রমিকও তাদের আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন।
জরিপে অংশ নেয়া এসব শ্রমিকরা বলছেন, করোনা-পূর্ববর্তী বছরে ওই সময়ে তাদের আয় এবং করোনাকালে তাদের আয়ের ব্যবধান ছিল অনেক বেশি।মোবাইল ফোনে পরিচালিত এ জরিপে অংশগ্রহণকারী পরিবার ছিল তিন হাজারের বেশি। ২০১৮ সালে পরিকল্পনা কমিশন পরিচালিত একই ধরনের জরিপে অংশ নেওয়া সাড়ে ১০ হাজার পরিবারের মধ্য থেকে তাদের বাছাই করা হয়।
সানেমের জরিপ বলছে, বেতন বা মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন এমন ৬২ শতাংশ কর্মী বা শ্রমিক গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের বেতন ২০১৯ সালের তুলনায় কমে গেছে বলে জানান। ৭ দশমিক ৯ শতাংশ শ্রমিক এ সময়ে কাজ হারানোর কথা জানান এবং এদের মধ্যে ১ দশমিক ৭ শতাংশ এখনো কাজ ফিরে পাননি। সাময়িকভাবে কাজ হারানোর এ হার ৫ দশমিক ৪। ৭ শতাংশ পুরুষ জানান এখনো তারা কাজে যোগ দিতে পারেননি; নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ১৬ শতাংশ।
কৃষি খাতে বেতন বা মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন এমন ৬৮ শতাংশ জানান, ২০১৯ সালের তুলনায় তাদের আয় কমে গেছে। তৈরি পোশাক খাতে এ হার ৬৯, অন্যান্য ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ৫৮, নির্মাণ খাতে ৭৪, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় ৫৭ এবং পরিবহন খাতে এ হার ৮০ শতাংশ। তবে ৩৮ শতাংশ কর্মজীবী এ সময়কালে তাদের বেতন কমেনি জানান। আর ২৮ শতাংশ জানান তাদের বেতন বা মজুরি কমলেও জরিপকালে আগের অবস্থায় এসেছে।
স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত এমন ২০ শতাংশ শ্রমিক বলেছেন, করোনাকালে তাদের আয় কমেনি। ৪৩ শতাংশ শ্রমিকের আয় কমলেও চলতি বছরের শুরুতে পূর্বের আয়ে ফিরে আসেন তারা। অন্যদিকে ৩৭ শতাংশ স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত শ্রমিক বলেছেন, তাদের আয় এখনো করোনা-পূর্বের চেয়ে অনেক কম।
শহর এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদের বিষয়ে সানেমের জরিপে বলা হয়, ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ শহুরে শ্রমিক কর্ম হারিয়ে এখন পর্যন্ত বেকারত্ব বয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রামের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বরিশালে ১৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১০ শতাংশ, ঢাকায় ৮ শতাংশ, খুলনায় ৩ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৮ শতাংশ, রাজশাহীতে ৫ শতাংশ, রংপুরে ১০ শতাংশ ও সিলেটে ৭ শতাংশ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন। অন্যদিকে প্রবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সানেমের জরিপ বলছে, ২০ শতাংশ কাজ হারিয়েছেন এবং ৫ শতাংশ দেশে ফিরে আসেন।
ওয়েবিনারের বিশেষ অতিথি আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পওতিয়ানেন বলেন, করোনা মহামারি সংকট কমে আসার প্রেক্ষাপটে মানুষ কাজে ফিরছে। কিন্তু কর্মসংস্থান সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, বা কর্মঘণ্টা কমে যাচ্ছে কিনা, তা দেখতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনের তুলনায় প্রণোদনা সুবিধা কম পাচ্ছে বলে জানান তিনি।
জরিপের ওপর আলোচনায় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ধীরে হলেও মানুষ কাজ ফিরে পাচ্ছে। এটা ভালো দিক। কিন্তু নতুন বিনিয়োগ না বাড়লে নতুন শ্রমশক্তির জন্যই কিছু করা যাবে না। বিদেশ থেকে যারা দেশে এসেছেন তাদের অনেকে ফিরে যেতে পারেননি। করোনার সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রেমিট্যান্স এসেছে, ভালো কথা। কিন্তু এটা প্রথাগত রেমিট্যান্স বলে মনে হয় না। কীভাবে আসছে এবং আবার চলে যাবে কিনা- তা নিয়ে ভাবতে হবে।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন রামরুর প্রধান ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যায়ে চার লাখ শ্রমিক বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন। তারা গড়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ফেলে এসেছেন। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অভিবাসীদের মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। ভবিষ্যতে এ জাতীয় সমস্যা সমাধানে তথ্যভান্ডারের প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৯৩৭
আপনার মতামত জানানঃ