বিশেষ প্রতিনিধি : দীর্ঘদিন যাবৎ জামায়াতকে ছাড়ার বিষয়ে বিএনপি’র ওপর দেশি ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে জামায়াতকে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি এবং উগ্রবাদী হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। ২০১৪’র নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াতের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকলেও প্রায় ছয় বছর ধরে জামায়াতের সাথে দূরত্ব রেখে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছে এবং তা পালন করছে। তাই জামায়াতে ইসলামীর এই থাকা, এক প্রকার দায় সারা উপস্থিতিই।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের নানা কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি যখন মাঠে নেমেছে, তখন দলটিতে জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার আলোচনা জোরালো হয়েছে।
বিএনপির তৃণমূল নেতাদের মতে, এখন আন্তর্জাতিক এবং দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোন কৌশল না খাটিয়ে জামায়তের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য, জামায়াতসহ কয়েকটি দলকে নিয়ে বিএনপি চার দলীয় জোট গঠন করেছিল সেই ১৯৯৯ সালে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তখন প্রথম দফায় ক্ষমতায়। সেই জোটই পরে ২০ দলীয় জোটে রূপ পেয়েছে।
জামায়াতকে ত্যাগে খালেদা জিয়ার ইতিবাচক জবাব
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, তাদের নীতি নির্ধারণী ফোরামে বিষয়টি আলোচনায় আসে গত বছরের শেষ দিকে। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় তাদের স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই জামায়াতের সাথে তাদের দলের জোটগত সম্পর্ক ছিন্ন করার পক্ষে মত দিয়েছেন। শুধু দু’জন সদস্য মত দিয়েছেন জামায়াতের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখার পক্ষে।
তারা আরও বলেছেন, স্থায়ী কমিটি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিষয়টিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাদের দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছ থেকে তারা এমন ইঙ্গিত পেয়েছেন।
খালেদা জিয়ার দু’টি মামলায় সাজা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে জেল থেকে মুক্তি নিয়ে ঢাকায় গুলশানের বাসভবনে অবস্থান করছেন তিনি। তবে দলীয় বা রাজনৈতিক কোন কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন না। গত বছরের শুরু থেকে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে ধারাবাহিকভাবে ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করে আসছে দলটির স্থায়ী কমিটি।
সম্প্রতি বিএনপি’র চেয়ারপারসনের সঙ্গে তার গুলশানের বাসা ফিরোজায় দেখা করেছেন দলটির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা। এ সময় বেগম জিয়ার সঙ্গে জামায়াত ইস্যু নিয়েও কথা বলেন তিনি। এ ব্যাপারে দলের শীর্ষ নেতার নির্দেশনা চান তিনি।
খালেদা জিয়া বিএনপি’র ওই নেতাকে বলেন, আমার কিছু বলার নেই। দলের মধ্যে যদি জামায়াতকে ছেড়ে দেয়ার মতামত এসে থাকে, তাহলে যা ভালো মনে করেন, করতে পারেন। জামায়াতের বিষয়ে নেয়া যেকোনো সিদ্ধান্তেই তার আপত্তি নেই বলেও জানান তিনি।
সূত্র জানায়, জামায়াতের বিষয়ে নিজের অভিমত লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া।
জামায়াতকে ত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা
এদিকে জামায়াতকে ছাড়ার বিষয়ে বিএনপি’র মধ্যে ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। গত ১লা মার্চ রাজধানীর গুলশানস্থ হোটেল লেকশোরে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করে বিএনপি। এই অনুষ্ঠানে বিএনপি ছাড়াও ২০ দল এবং ঐক্যফ্রন্টের অধিকাংশ নেতা উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না জামায়াতে ইসলামীর কোনো নেতা।
সূত্রে জানা গেছে, সুবর্ণ জয়ন্তীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বিতর্কমুক্ত রেখে একে সর্বজনীন রূপ দিতে জামায়াতকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। তাদের দাওয়াত না দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপি’র হাইকমান্ডের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি’র স্বাধীনতা উদযাপন কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, এতোদিন খালেদা জিয়ার মতামত নেয়াই ছিল বড় বিষয়। এখন যেহেতু ওনার মতামত পাওয়া গেছে, ফলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ এবং সময় কম লাগবে।
বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের অবনতি
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সে সময় জামায়াত কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বা কোন প্রতিবাদ করেনি। সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে তখন থেকেই বিএনপির তৃণমূলে জামায়াত নিয়ে একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হতে থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিএনপি বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়লেও জামায়াতকে বিএনপি সেভাবে পাশে পায়নি। বরং জামায়তের অনেক কর্মকাণ্ডের দায় বিএনপিকে বহন করতে হয়েছে বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন।
২০১৫ সাল থেকেই মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের সাথে বিএনপির নেতা কর্মীদের সম্পর্কের টানাপোড়েন চরমে পৌঁছায়। বিএনপির নেতৃত্বও দলের হতাশা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য জামায়াতকে বাদ দিয়ে নিজেরা দলীয়ভাবে কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করে।
দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, জেলা- উপজেলা পর্যায়ে বা তৃণমূল স্তরে বিএনপির নেতা কর্মীদের এখন জামায়াতের সাথে কোন যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। আর বিএনপির তৃণমূল থেকেই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য দলটির নেতৃত্বের ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে।
দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্ব সারাদেশের নেতা কর্মীদের মতামত নিয়েছিল। সে সময় সারাদেশ থেকেই তাদের তৃণমূল স্তরের নেতাকর্মীরা জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার সুপারিশ করেছিলেন।
জামায়াতকে ত্যাগের কারণ
সূত্র মতে, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার ক্ষেত্রে বিএনপি নীতি নির্ধারকরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাবকে বড় বিষয় হিসাবে দেখছেন।
দলটির একজন নেতা জানিয়েছেন, সেই ২০১৪ সাল থেকেই তারা যখন ঢাকায় পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের সাথে কথা বলতে গেছেন, তখন জামায়াতের সাথে জোটের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব তারা উপলব্ধি করেছেন। ফলে এই বিষয়টিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
সূত্র মতে, বিএনপি যখন জামায়াতকে নিয়ে জোট গঠন করেছিল, তখন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর একটা প্রভাব তৈরির লক্ষ্য তাদের ছিল। সে সময় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর জামায়াতের প্রভাবও ছিল। কিন্তু পরে কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উত্থানের প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতিতে অনেক মেরুকরণ হয়েছে। সেখানে একক কোন ইসলামপন্থী দলের প্রভাব কমেছে বলেও বিএনপি নেতারা মনে করেন।
এছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের র্শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি বা সাজা হয়েছে।
রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে বিএনপির জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবেই নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। জামায়াতে ইসলামী বাঘের গলায় আটকে যাওয়া হাড় হয়ে উঠেছে বিএনপির জন্য। সমর্থনের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়েছে এই জোটের জন্য। বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি। এই ক্ষমতায় না থাকাকে বিএনপি সুবিধায় পরিণত করতে পারে। বিএনপির উচিত এই সুযোগে প্রয়োজনীয় রদবদল করে নতুন দিনের রাজনীতি শুরু করা। যদিও বিএনপিকে ভবিষ্যৎ জোট ও ভোটের রাজনীতির হিসাব মাথায় রেখেই সবকিছু করতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২১
আপনার মতামত জানানঃ