খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে পাহাড় কাটা থামানোই যাচ্ছে না। উল্টো দিনদিন বেড়েই চলছে। প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে সাবাড় করলেও দেখার কেউ নেই। এর ফলে পরিবেশ যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে, তেমনি কমছে জঙ্গল, পশু-পাখি হারাচ্ছে আবাসস্থল। দিনের পর দিন সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে পাহাড় কাটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখনো বন্ধ হয়নি অবৈধভাবে পাহাড় কাটা। পরিবেশকর্মীরা বারবার বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এনে পাহাড় কাটা বন্ধের আহ্বান জানালেও এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি নেই প্রশাসনের। কেননা এসব পাহাড় কাটার পেছনে রয়েছেন মহালছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রতন শীল। তিনি মহালছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ ছাড়াই জেলার মহালছড়িতে উন্নয়ন কাজের কথা বলে প্রকাশ্যে পাহাড় কাটছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মহালছড়ি উপজেলায় স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের আওতায় প্রায় ১৮শ মিটার রাস্তা কার্পেটিংয়ের কাজ চলছে। এর নির্মাণ ব্যয় ৩ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা। ঠিকাদার হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পায় সিকদার এন্টারপ্রাইজ ও কবি রঞ্জন ত্রিপুরা। তবে উপ-ঠিকাদার হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছেন মহালছড়ি সদর ইউপি চেয়ারম্যান রতন শীল। আর এই রাস্তা নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে পাহাড়ের মাটি। এর জন্য মহালছড়ি-চোংড়াছড়ি সড়কের শান্তি নগর এলাকায় খাড়া পাহাড় কাটা হচ্ছে। প্রতিদিনই মাটিবাহী ট্রাক্টর পাহাড় কেটে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় শত ফুট উচ্চতার খাড়া পাহাড়ের একটি বড় অংশ কাটা হয়েছে। পাহাড় কাটা এখনো অব্যাহত রয়েছে। খাড়াভাবে পাহাড় কাটায় আসন্ন বর্ষায় পাহাড়ের বাকি অংশ ধসে পড়ার আশংকা রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতি বছর ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হলো অবাধে পাহাড় কাটা। পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের কোনো ছাড়পত্র ছাড়াই দিনে-দুপুরে পাহাড় কাটার মহোৎসব চলছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পাহাড়ের মালিক মো. আব্দুর রহিম জানান, নির্মাণাধীন রাস্তা সমান করার জন্য পাহাড়ের মাটি কাটছেন রতন চেয়ারম্যান। বেশ কয়েক দিন ধরে কাটার পর পাহাড়ের একটি বড় অংশ কাটা শেষ হয়েছে।
এ সময় তিনি বলেন, এতে বর্ষায় পাহাড় ধসে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী জানান, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়কাটার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্ষায় পার্বত্য জেলায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। প্রশাসনিকভাবে পাহাড়কাটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এমনটি চলছে। অবিলম্বে তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করা না গেলে ভয়াবহ পরিবেশ ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মহালছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রতন শীল বলেন, আমি রাস্তার কাজ করছি। রাস্তা সমান করার জন্য পাহাড়ের মাটি ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে তিনি পাহাড়কাটার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলে দাবি করেন এবং পাহাড়কাটা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন না করার অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬(খ) অনুযায়ী পরিবেশ সুরক্ষায় পাহাড় কাটা সম্পর্কে বাধা-নিষেধ রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন ও/বা মোচন করা যাবে না।
কিন্তু পাহাড় কাটা অবৈধ হলেও খাগড়াছড়িতে পাহাড় কাটা থামছে না। খাগড়াছড়ি জেলার ৯ উপজেলায় গত এক দশকে হারিয়ে গেছে শতাধিক পাহাড়। শক্ত আইন থাকলেও প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এসব পাহাড় কেটে জায়গা সমতল করা হয়েছে। এখনও অব্যাহত রয়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালীদের পাহাড় কাটা। বেশিরভাগ পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, দোকান পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এক তৃতীয়াংশ পাহাড় কেটে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলেও বাকি দুই-তৃতীয়াংশে বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও রাস্তাঘাট নির্মাণে নির্বিচারে কাটা হয়েছে পাহাড়। এর ফলে পরিবেশ যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে, তেমনি কমছে জঙ্গল, পশু-পাখি হারাচ্ছে আবাসস্থল।
পরিবেশকর্মীরা বারবার বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এনে পাহাড় কাটা বন্ধের আহ্বান জানালেও এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি নেই প্রশাসনের। মাঝে মাঝে দু’একবার অভিযান চালিয়ে, দু’চারজনকে জেল-জরিমানা করেই নিজেদের কাজ শেষ করছে প্রশাসন। তবে পরিবেশকর্মীদের আশঙ্কা, এভাবে পাহাড় কাটা চলমান থাকলে পার্বত্য এলাকা হিসেবে হারিয়ে যাবে খাগড়াছড়ির সুনাম, আরও হুমকির মুখে পড়বে পরিবেশ।
পরিবেশকর্মীরা মনে করেন, খাগড়াছড়িতে ক্রমাগত পাহাড় কাটার কারণে বর্ষাকালে অনেক পাহাড় ধসে খাল বিল ভরে যাচ্ছে, পাহাড় ধসে ঘরবাড়িতে পড়ে জীবন ও সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, পরিবেশ ও প্রাণিকুল নষ্ট হচ্ছে। এক কথায় জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে পাহাড় রক্ষা করতেই হবে। এজন্য দরকার প্রশাসনের শক্ত হস্তক্ষেপ।
এসডব্লিউ/ডিজে/কেএইচ/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ