বাঙালি জাতির ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। ভাষার জন্য সংগ্রাম করে এদেশের সূর্যসন্তানরা জীবন দিয়েছেন। যে ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য আত্মত্যাগ, সেই ভাষাই এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি উচ্চ আদালতে। শুধু উচ্চ আদালতেই নয়, দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালতেও উপেক্ষিত মাতৃভাষা বাংলা।
সাধারণ মানুষ ও বিচারপ্রার্থীরা যাতে রায় বুঝতে ও জানতে পারেন, সে জন্য ইংরেজিতে দেওয়া রায় বাংলায় অনুবাদ করতে সুপ্রিম কোর্টে যুক্ত হয়েছে নতুন সফটওয়্যার। ‘আমার ভাষা’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংবলিত ওই সফটওয়্যারের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের রায়গুলো বাংলায় অনুবাদ করা যাবে। এ ছাড়া আদালতে বাংলাভাষার প্রয়োগকে আরও সহজ করতে আইন কমিশনের উদ্যোগে ১০ হাজারেরও বেশি বাংলা পরিভাষা নিয়ে মুদ্রিত হয়েছে ‘আইন-শব্দকোষ’।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন গত বৃহস্পতিবার ( ১৮ ফেব্রুয়ারি) সফটওয়্যারটি উদ্বোধন করেন। গতকাল শনিবার এ তথ্য জানান সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান।
ভাষার মাস চলতি ফেব্রুয়ারিতে আপিল বিভাগ থেকেও বাংলায় রায় দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা সাত। আপিল বিভাগের দুটি বেঞ্চে একটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনি চলতি মাসে একাধিক মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছেন। আপিল বিভাগের অপর বেঞ্চের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। তিনিও চলতি মাসে বাংলায় রায় দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান।
গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ঔপনিবেশিক আমল থেকে আদালতের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষাতে পরিচালিত হয়ে আসছে। আদালতে এ কারণেই ইংরেজি ভাষায় রায় ও আদেশ প্রদানে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া আইন বিষয়ে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত বাংলা পরিভাষা ও পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে উচ্চ আদালতে শতভাগ বাংলা ভাষার প্রচলন করার বাস্তবসম্মত অসুবিধা এখনো রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যারটি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। আগামীতে দেশের আদালতে আর এ রকম কোনো অনুবাদ সফটওয়্যার প্রয়োজন হবে না। কারণ সরকার আদালতসহ রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন করে একুশের চেতনাকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে ৯৯ জন বিচারপতি আছেন। বছরদশেক আগেও বাংলায় রায়-আদেশ দেওয়ার সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। বিচারপতিদের যারা বাংলায় রায় লিখেন, তারা তা লিখছেন মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার টানে। বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন তারা।
সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন বিষয়ে এবং বেতার ও দূরদর্শনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ এবং দূষণ রোধে হাইকোর্টের রুলসহ নির্দেশনা রয়েছে। দুটি নির্দেশনাই এসেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। একটি ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, অন্যটি ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। একটির ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, অন্যটিতে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় আদেশ দেন হাইকোর্টের পৃথক দুটি বেঞ্চ। কিন্তু এর বাস্তবায়নও এখনো কার্যত হয়নি।
গত বছর আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। দেশের ইতিহাসে এ মামলার আসামির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আর রায়ের পৃষ্ঠার সংখ্যার দিক থেকেও এটি সবচেয়ে বড় রায়। সেই রায়ের ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠা বাংলায় লিখে আলোচনায় এসেছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী। ওই রায়ের অনুলিপি সংরক্ষণের জন্য বাংলা একাডেমিতে হস্তান্তর করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন।
হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান বেশির ভাগ রায়, আদেশ ও নির্দেশ বাংলায় দিচ্ছেন। ১৫ হাজারের বেশি রায় বা আদেশ বাংলায় দিয়েছেন তারা। গত বছর ভাষার মাসে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়া শুরু করেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ। সে বছর ভাষার মাসে তিনি বিভিন্ন মামলায় ১ হাজার ১৭৫টি রায় ও ৬৩৭টি আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। এই বেঞ্চ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আলোচিত গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলার রায়ও দিয়েছেন বাংলায়।
হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন যোগদানের পর নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি মামলার রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন এই বিচারপতি। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন তিনি। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল নিয়মিত বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন। এর আগে বাংলায় রায় লিখেছেন বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি এআরএস আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি একে বদরুল হক, বিচারপতি ফজলুল করিম, বিচারপতি মোয়াজ্জেম হোসেন, বিচারপতি মো. আবদুল কুদ্দুস, বিচারপতি এসএম জিয়াউল করিম, বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদিন, বিচারপতি মো. হাসান আমীম, বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন প্রমুখ।
১৯৯৯ সালে উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারক বাংলায় রায় লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগে কোনো রায় বাংলা ভাষায় দেওয়া হয়নি। ২০০৭ সাল থেকে হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট মামলায় কয়েকটি রায় বাংলায় দেওয়া হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ২০০৭ সাল থেকে ২০১১-তে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২০০ রায় বাংলা ভাষায় লিখেছেন।
সুপ্রিমকোর্টে প্রায় ১০ হাজার আইনজীবীর মধ্যে মাত্র দুজন- অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও আবু ইয়াহিয়া দুলাল উচ্চ আদালতে বাংলায় মামলা দায়ের ও শুনানি করছেন। কিন্তু তারা আদালতের রায় বা আদেশের কপি পান ইংরেজিতে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ আদালতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার ব্যবহারে কোনো বাধা নেই। অন্য ভাষা থেকে বাংলায় ভাষান্তর করতেও কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উচ্চ আদালতে এখন বাংলায় রায় দেওয়া বাড়ছে। তিনি বলেন, আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়মিত চর্চা ও অনুশীলনের বিষয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলা ভাষায় আইনের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য বর্তমানে সফটওয়্যার, পরিভাষা কোষও তৈরি হয়েছে। এখন প্রয়োজন বিচারকদের সদিচ্ছা। বাংলা ভাষার যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত শব্দভাণ্ডার এবং দিক-বিস্তৃত ব্যাকরণপ্রণালি, তাতে আইনের কাজ চলবে না, এটা খোঁড়া যুক্তি বৈ কিছু নয়। ভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ আর ভাষা আন্দোলনের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা কেবল কথার মাধ্যমে নয়; আমাদের কাজের মাধ্যমে প্রতিফলিত হোক। ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’_ এই অক্ষয় উচ্চারণ কেবল স্লোগানেই নয়; আমাদের মনন আর মগজলিপিতেও দীপ্র হোক। আমাদের উচ্চ আদালতও ঘাড় উঁচু করেই দেখুক বাংলা ভাষার পারাবারপ্রতিম উচ্চতা। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে উচ্চ আদালতের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই এই প্রত্যাশাটুকু জানানো যাক। মাথা নত না করেই জানানো যাক।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ