ঢাকাসহ দেশের সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। প্রাণহানির বড় কারণ বেপরোয়া মোটরসাইকেল। সড়কে প্রায় ৩০ ভাগ দুর্ঘটনাই মোটরসাইকেল আরোহীর ঘন ঘন লেন পরিবর্তন, নিয়ম না জানা বা জানলে না মানা, যানজট এড়িয়ে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছার কারণে ঘটছে।
যানজটের এই শহরে দ্রুত গন্তব্যে যাওয়া এবং সহজলভ্যতার কারণে জনপ্রিয় বাহন হয়ে উঠেছে মোটর সাইকেল। এই বাহনকে বাণিজ্যিকভাবে মানুষের আরো কাছে নিয়ে গেছে রাইড শেয়ারিং ও ই-কমার্স অ্যাপগুলো। ফলে, মোটর সাইকেল কিনে নতুন কর্মসংস্থানের আশায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে ভিড় করছেন যুবকরা। যাদের অনেকেরই ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। অনেকটা অচেনা এই শহরে অদক্ষ এসব চালক বেপরোয়া ভাবে বাইক চালানোয় বাড়ছে দুর্ঘটনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের ২৫ শতাংশই ঢাকায়। প্রতিদিন মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হচ্ছে গড়ে ৪১৫টি। এছাড়াও বিআরটির তথ্যমতে, সারা দেশে ৩১ লাখ মোটরসাইকেল রয়েছে। তবে এর মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ১৮ লাখ চালকের। তবে সম্প্রতি মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ফি কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। নতুন নির্ধারিত ফি’র কারণে এখন থেকে গ্রাহকদের নিবন্ধন খরচ অর্ধেক কমে যাচ্ছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় নিবন্ধন ফি কমানোর যে প্রস্তাব দিয়েছিল তা ইতোমধ্যে অনুমোদন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পরিমান বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এখনই বিকল্প ব্যবস্থা না নেয়া হলে সামনে আরো ভয়াবহ অবস্থা দেখা দিবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, শুধু নিবন্ধনের ফি নয়, দামও কমিয়ে দিয়ে মানুষকে মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহী করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে গণপরিবহন বাড়ানো হচ্ছে না। সারা বিশ্বে গণপরিবহণ উন্নতি করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র উল্টো। তাই বেশি বেশি মোটরসাইকেলে ক্রয় করছে মানুষ। এছাড়াও বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোটরসাইকেল সংস্কৃতি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্মের যারা রাজনীতির সাথে জড়িত তারা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালচ্ছে। তবে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহনকে উন্নত করলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
চলতি বছর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের করা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে দেশে ৪ হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং ৭ হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছেন। এতে বলা হয়, গত বছর ১ হাজার ৩৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪৬৩ জন নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহত মানুষের ২৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি, ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা এবং অসাবধানতাই এসব দুর্ঘটনার কারণ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। প্রাণহানি বেড়েছে চার দশমিক ২২ শতাংশ এবং আহতের হার বেড়েছে তিন দশমিক ৮৮ শতাংশ। আগের বছরে তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। করোনার সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালে দুই মাস সড়কে পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকার পরেও দুর্ঘটনা ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা আনতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেওয়া ১৮ নির্দেশনার মধ্যে মোটরসাইকেল চালনায় সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে হেলমেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তার আগে থেকেই তিন আরোহী নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এখন আর মোটরসাইকেল চলাচলে কঠোর নজরদারি নেই।
সূত্র জানায়, রাজধানীর প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে মোটরসাইকেলচালকদের কারণে পথচারী ও যাত্রীরা ত্যক্তবিরক্ত। বেশির ভাগ মোটরসাইকেল চালকই অন্য যানবাহনকে অতিক্রম যাওয়ার চেষ্টা করে সবসময়। সে ক্ষেত্রে তারা নিয়ম না মেনে উল্টোপথে, ফুটপাত দিয়েও বাহনটি চালিয়ে যায়। বাজাতে থাকে হর্ন। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার ছাড়াও চুক্তিতে মোটরসাইকেল চলছে রাজধানীতে। সে কারণে মোড়ে মোড়ে যেন মোটরসাইকেলের বাজার বসে। গুলশান, কুড়িল, বাড্ডা, ধানমণ্ডি-২৭, মৌচাক, মালিবাগ, শাহবাগ, সায়েদাবাদ, তেজগাঁও সাতরাস্তা, মগবাজার, বিমানবন্দর রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে ডেকে ডেকে যাত্রী তোলে মোটরসাইকেল চালকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরবাইক দুর্ঘটনা শীর্ষে থাকার প্রধান কারণ হেলমেট ব্যবহার না করার প্রবণতা, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও বেপরোয়া ড্রাইভিং৷ আর অদক্ষ এবং লাইসেন্সবিহীন চালকতো আছেই৷
বিআরটিএর মুখপাত্র পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, সঠিক নিয়ম মেনেই লাইসেন্স দেয়া হয়। কিন্তু লাইসেন্স নেয়ার পর চালকরা নিয়ম মানেন না। এছাড়াও অনেকেই লাইসেন্স না নিয়ে মোটারসাইকেলে চালাচ্ছেন। এমনকি যত্রতত্র মোটরসাইকেল চালানোর কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন তিনি।
রহমত আলী নামের এক মোটরসাইকেল চালক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, যারা বাস চালায় তারা ডানে-বামে দেখে না। হুট করে তারা রিকশা ও মোটর সাইকেলকে চাপা দেয়। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। তবে রহিম মিয়া নামের এক বাস চালক বলেন, মোটরসাইকেল চালকরা নিয়ম না মেনে বেপরোয়াভাবে রাস্তায় চলাচল করে। এতে দুর্ঘটনার শিকার হন।
ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যেসব জায়গায় দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেলে চলছে ওইসব এলাকায় কিছু লেন থাকলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। এক্ষেত্রে যেসব জায়গায় রাস্তা বড় আছে, সেই সব জায়গায় লেন করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে পুলিশ ও সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থার সাথে সম্বনয় করে লেন করা হবে। এছাড়া সবাই সচেতন ও আইনের বাস্তবায়ন করলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই মোটরবাইক থ্রি ও ফোর হুইলারের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ৷ কারণ এটি দুই চাকার ওপর চলাচল করে৷ বাংলাদেশে বাস্তবে মোটরবাইকের দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি৷ রিপোর্টে সব আসে না৷ রাইড শেয়ারিং-এর নামে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে যে বিপুল পরিমাণ মোটরবাইক নেমেছে তা ইতিমধ্যেই সংকট তৈরি করছে৷ এখন প্রচুর ফ্রিল্যান্স মোটরবাইকার আছে৷ ফলে নিরাপত্তা ও সড়ক ব্যবহারের দিক থেকে বড় সংকট তৈরি করবে যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়৷ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া এরইমধ্যে এই সংকটে পড়েছে৷ তাদের সড়ক দুর্ঘটনার ৬০ ভাগ এখন মোটরবাইকের কারণে। ঢাকা শহরে মোট কত মোটরবাইক চলাচল করছে তার সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন৷ কারণ যেখান থেকেই মোটরবাইক নিবন্ধন করা হোক না কেন তা সারাদেশেই চলতে পারে৷ আইন বা জরিমানা করে সড়ক দুর্ঘটনা পুরোপুরি রোধ সম্ভব নয়। বরং আইন ও নিয়ম-কানুন যাতে মানুষ মেনে চলে সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ