রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে খালেদা জিয়ার জানাজা শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদায় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনিবার্য অধ্যায়। এই জানাজা ইতিহাসের অংশ, কারণ এখানে মিলেছে সময়, ক্ষমতা, সংগ্রাম, আবেগ এবং একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক যুগের সমাপ্তি। যে মানুষটি জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে, যিনি একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, আবার একই সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ, কারাবাস ও অসুস্থতার মধ্য দিয়ে জীবন পার করেছেন—তাঁর শেষ বিদায় স্বাভাবিকভাবেই ইতিহাসে স্থান করে নেয়।
খালেদা জিয়া ছিলেন স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্রগুলোর একজন। সামরিক শাসনের পর গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তাঁর উত্থান, একজন সেনাপ্রধানের স্ত্রী থেকে দলীয় নেত্রী হয়ে ওঠা, এবং পরে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া—এই পুরো যাত্রাই ইতিহাসের উপাদান। তাঁর জানাজায় যে বিপুল মানুষের উপস্থিতি দেখা গেল, তা কোনো হঠাৎ আবেগের বিস্ফোরণ নয়; এটি দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সম্পর্ক, আনুগত্য ও স্মৃতির বহিঃপ্রকাশ।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ নিজেই একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখানেই হয়েছে বহু গণসমাবেশ, আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। এই জায়গায় খালেদা জিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রতীকী অর্থ বহন করে। এটি যেন বলে দেয়, তিনি শুধু একটি দলের নেত্রী ছিলেন না, তিনি রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন। তাঁর জানাজায় উপস্থিত মানুষেরা শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিতে আসেননি, তাঁরা সাক্ষী হতে এসেছেন ইতিহাসের এক নীরব মুহূর্তে।
এই জানাজা ইতিহাসের অংশ আরেকটি কারণে—এটি একটি রাজনৈতিক প্রজন্মের বিদায়। খালেদা জিয়ার রাজনীতি শুরু হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন দেশের গণতন্ত্র ছিল ভঙ্গুর, রাজনীতি ছিল সংঘাতমুখর। তিনি দেখেছেন সামরিক শাসন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার, আবার দেখেছেন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। তাঁর জানাজায় যারা এসেছেন, তাঁদের অনেকেই সেই সময়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী। তরুণ থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষের উপস্থিতি দেখায়, তাঁর রাজনৈতিক জীবন একাধিক প্রজন্মকে ছুঁয়ে গেছে।
খালেদা জিয়ার জানাজা ইতিহাসের অংশ, কারণ এটি নারীর নেতৃত্বের ইতিহাসের সঙ্গেও যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব বিরল নয়, কিন্তু বাংলাদেশে খালেদা জিয়া যে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন, তা ব্যতিক্রমী। তিনি শুধু একজন নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন কঠোর, আপসহীন রাজনৈতিক নেতা—এই পরিচয় তাঁকে আলাদা করেছে। তাঁর জানাজায় নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি সেই ইতিহাসেরই প্রতিফলন।
এই জানাজা ইতিহাসের অংশ আরেকটি দিক থেকে—এটি আবেগের রাজনৈতিক ভাষা। “খালেদা জিয়া একটা অনুভূতির নাম”—এই কথাটি বারবার শোনা গেছে। ইতিহাস শুধু দলিল, তারিখ আর ঘটনার সমষ্টি নয়; ইতিহাস মানুষের অনুভূতির মধ্য দিয়েও বাঁচে। যাঁরা দূর জেলা থেকে রাতভর ভ্রমণ করে এসেছেন, যাঁরা হেঁটে জানাজাস্থলে পৌঁছেছেন, তাঁদের এই কষ্ট ইতিহাসের নীরব উপাদান। এগুলো ভবিষ্যতের ইতিহাসচর্চায় পরিসংখ্যান নয়, বরং সামাজিক স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবে।
খালেদা জিয়ার জানাজা ইতিহাসের অংশ কারণ এটি ক্ষমতা ও অসহায়তার দ্বন্দ্বকে সামনে আনে। যিনি একসময় রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, যাঁর সিদ্ধান্তে দেশের গতিপথ বদলেছে, তাঁর শেষ বিদায়ে মানুষকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে, হেঁটে আসতে হয়েছে, চোখের জল ফেলতে হয়েছে। এই দৃশ্য ক্ষমতার ক্ষণস্থায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়, যা ইতিহাসের চিরন্তন শিক্ষা।
নিরাপত্তাবলয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতি, রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব—সব মিলিয়ে এই জানাজা একটি জাতীয় ঘটনার রূপ নিয়েছে। যদিও এটি কোনো রাষ্ট্রীয় জানাজা নয়, তবু বাস্তবে এটি রাষ্ট্রের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে যখন এই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস লেখা হবে, তখন খালেদা জিয়ার মৃত্যু ও জানাজার বর্ণনা সেখানে অনিবার্যভাবে স্থান পাবে।
এই জানাজা ইতিহাসের অংশ, কারণ এটি প্রশ্নও রেখে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে এগোবে? এই প্রজন্মের নেতাদের বিদায়ের পর নতুন নেতৃত্ব কীভাবে ইতিহাসের ভার বহন করবে? খালেদা জিয়ার জানাজা সেই প্রশ্নগুলোকে নীরবে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। মানুষ শুধু অতীতকে বিদায় জানায়নি, তারা ভবিষ্যতের দিকেও তাকিয়েছে—যদিও সেই তাকানোয় ছিল অনিশ্চয়তা।
শেষ পর্যন্ত, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে খালেদা জিয়ার জানাজা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে, কারণ এটি ছিল সময়ের এক স্থিরচিত্র। হাজারো মানুষের ভিড়, নীরব প্রার্থনা, চোখের জল, ক্লান্ত শরীর—সব মিলিয়ে এটি একটি জাতির স্মৃতিতে গেঁথে যাওয়ার মতো মুহূর্ত। ব্যক্তি খালেদা জিয়া এখানে ইতিহাসে রূপ নিয়েছেন, আর তাঁর জানাজা হয়ে উঠেছে সেই ইতিহাসের এক জীবন্ত
আপনার মতামত জানানঃ