ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়টা হঠাৎ করেই রক্তাক্ত ও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। পুরানা পল্টনের ব্যস্ত কালভার্ট রোডে জুমার নামাজের পর প্রকাশ্য দিবালোকে রিকশায় বসে থাকা এক রাজনৈতিক কর্মীকে মাথায় গুলি করে হত্যা—ঘটনাটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন রাজনীতির প্রভাব, সীমান্তপথে পালিয়ে যাওয়ার নেটওয়ার্ক, অপরাধ জগতের দালালচক্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘ অনুসন্ধান। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদি হত্যার ঘটনাটি ধীরে ধীরে একটি জটিল রাজনৈতিক–অপরাধমূলক কাহিনিতে রূপ নেয়।
শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি গণসংযোগ করছিলেন, এলাকায় এলাকায় পরিচিত মুখ হয়ে উঠছিলেন। ইনকিলাব মঞ্চের ব্যানারে তিনি যে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতেন, তাতে অনেকেই তাঁকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হিসেবে দেখছিলেন। ১২ ডিসেম্বর, শুক্রবার, নামাজ শেষে যখন তিনি পুরানা পল্টনের কালভার্ট রোড দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই মোটরসাইকেলে আসা দুজন আততায়ী খুব কাছ থেকে গুলি চালায়। একটি গুলি তাঁর মাথায় লাগে। মুহূর্তেই এলাকা আতঙ্কে ফেটে পড়ে, আর আততায়ীরা দ্রুত মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাদিকে প্রথমে ঢাকার হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। দেশজুড়ে তখন তাঁর সুস্থতার জন্য দোয়া ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর খবর আসার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের পাশাপাশি ক্ষোভও তীব্র হয়। রোববার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে তাঁর জানাজায় লাখ লাখ মানুষ অংশ নেয়। পরে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিস্থলের পাশে দাফন করা হয়।
হাদির মৃত্যুর পর তদন্তে নামে পুলিশ ও র্যাব। শুরু থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের মামলা হিসেবে বিবেচনা করে। কারণ এটি শুধু একজন রাজনৈতিক কর্মী হত্যার ঘটনা নয়, বরং এর পেছনে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সংগঠিত অপরাধ এবং সীমান্তপথে পলায়নের ইঙ্গিত স্পষ্ট ছিল। খুব দ্রুতই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত হিসেবে দুজনের নাম সামনে আসে—ফয়সাল করিম মাসুদ এবং আলমগীর শেখ। ফয়সাল ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, আর আলমগীর আদাবর থানা যুবলীগের কর্মী। তদন্তকারীদের ধারণা আরও দৃঢ় হয় যে, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
ঘটনার পরপরই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ফয়সাল ও আলমগীরের গতিবিধি বিশ্লেষণ শুরু করে। মোবাইল ফোনের লোকেশন, কল ডিটেইলস এবং যাতায়াতের তথ্য মিলিয়ে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের রাতেই তাঁরা ঢাকা ছাড়েন। একাধিকবার যানবাহন পরিবর্তন করে তাঁরা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত এলাকায় পৌঁছে যান। সেখান থেকেই তাঁরা অবৈধভাবে ভারত সীমান্ত পার হন। এই তথ্য সামনে আসার পর তদন্তের দিক ঘুরে যায় পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাকারীদের দিকে।
তদন্তে বেরিয়ে আসে, ফয়সাল ও আলমগীরের এই সীমান্ত পার হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মিরপুর এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি বাপ্পী নামেও পরিচিত। স্থানীয় সূত্র জানায়, তাইজুল ছিলেন মিরপুর এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার ঘনিষ্ঠ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি নিজেও ভারতে পালিয়ে যান বলে জানা যায়।
তাইজুল একা নন, এই পুরো ব্যবস্থায় তাঁর ভগ্নিপতি আমিনুল ইসলামও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন বলে তদন্তে উঠে আসে। পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডের পরপরই তাইজুল ভারত থেকে আমিনুলকে ফোন করে জানান যে, সীমান্ত এলাকার একজন দালাল ফিলিপ স্নালের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হচ্ছে না। তাইজুল আমিনুলকে নির্দেশ দেন যেন তিনি দ্রুত ফিলিপের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়ে দেন—দুই ব্যক্তিকে ওই রাতেই সীমান্ত পার করাতে হবে।
ফিলিপ স্নাল হালুয়াঘাট সীমান্তসংলগ্ন ভুটিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয়ভাবে তিনি একজন পরিচিত দালাল, যিনি টাকার বিনিময়ে মানুষকে অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে থাকেন। আমিনুল ইসলাম ফিলিপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং তাইজুলের বার্তা পৌঁছে দেন। এরপর বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি আবার তাইজুলকে জানান। তদন্তে জানা যায়, তাইজুলের নির্দেশেই আমিনুল তাৎক্ষণিকভাবে ফিলিপকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠান, যাতে ওই রাতেই ফয়সাল ও আলমগীরকে সীমান্ত পার করানো যায়।
এই সময়ের মধ্যে ফয়সাল ও আলমগীর ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে একাধিকবার যানবাহন পরিবর্তন করেন, যেন তাঁদের গতিবিধি সহজে ধরা না পড়ে। শেষ পর্যন্ত তাঁরা হালুয়াঘাট সীমান্তে পৌঁছান এবং সেখান থেকে ফিলিপের সহায়তায় ভারতে প্রবেশ করেন। পরে গোয়েন্দা পুলিশ সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ফিলিপের দুজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ওই দুই ব্যক্তিকে পার করানোর পর টেলিভিশনের খবর দেখে তাঁরা বুঝতে পারেন—এরা ঢাকায় বড় ধরনের একটি ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে ফিলিপকে সতর্ক করা হলে তিনিও আত্মগোপনে চলে যান।
গোয়েন্দা পুলিশের অনুসন্ধান এখানেই থেমে থাকেনি। কল রেকর্ড, লোকেশন ডেটা এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে ফিলিপ ও তাইজুলের যোগাযোগের স্পষ্ট প্রমাণ পায়। এর ভিত্তিতে আমিনুলকে মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ফয়সাল ও আলমগীরকে পালাতে সহায়তার অভিযোগে আমিনুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, আমিনুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এবং তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্লেষণে তাঁর সঙ্গে ঘটনার দিন ফিলিপ ও তাইজুলের সরাসরি যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তকারীরা আরও জানান, আমিনুল চোরাই মুঠোফোন কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা তাঁর অপরাধ জগতের সঙ্গে সংযোগ থাকার ইঙ্গিত দেয়।
অন্যদিকে, আমিনুল ইসলামের পরিবার এই গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে।
তাঁর স্ত্রী নাজমা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ছয় মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি মোবাইল ফোনের ব্যবসা শুরু করেন। কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। তবে তদন্তকারীরা বলছেন, পারিবারিক দাবি থাকলেও প্রযুক্তিগত প্রমাণ ও সাক্ষ্য–তথ্য আমিনুলের জড়িত থাকার দিকেই ইঙ্গিত করছে।
এই হত্যাকাণ্ড ও পলায়নের পুরো ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার একটি বড় চিত্র তুলে ধরে। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, তারপর সংগঠিতভাবে সীমান্ত পার হওয়ার ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে এটি শুধু ব্যক্তিগত শত্রুতা নয়, বরং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেটওয়ার্কের অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত। হাদি হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাব ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, মূল শুটার ফয়সাল ও তাঁর সহযোগী আলমগীরকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত তদন্ত শেষ হবে না।
হাদি হত্যাকাণ্ড তাই এখন শুধু একটি মামলার নাম নয়; এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা, অপরাধ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের এক ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি। তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই নতুন নতুন নাম, যোগাযোগ এবং নেপথ্যের গল্প সামনে আসছে। এই মামলার শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আর প্রকৃত নির্দেশদাতারা আদৌ আইনের আওতায় আসবে কি না—সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো অধরা।
আপনার মতামত জানানঃ