অগ্রহায়ণ মাস গ্রামের মানুষের জীবনে উৎসব ও অর্থনীতির এক বিশেষ সময়। এই সময়ই মাঠের ধান ঘরে ওঠে, কৃষকের হাতে কিছু অতিরিক্ত আয় আসে এবং সেই আয়কে কেন্দ্র করেই গ্রামে দেখা দেয় এক ধরনের সামাজিক উচ্ছ্বাস। নবান্ন আয়োজন, পিঠাপুলি, আত্মীয়স্বজনের সমাগম, নানা সামাজিক আড্ডা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—সব মিলিয়ে গ্রামবাংলায় অগ্রহায়ণ মানে উৎসবের মৌসুম। দীর্ঘ শীতের রাতকে উদ্যাপন করতে আবহমানকাল ধরেই আয়োজন হয়ে আসছে পালাগান, বাউলগান, যাত্রাপালা, গাজির গান, মাজারে ওরস শরিফ কিংবা বিভিন্ন ধরনের জলসা। এসব আয়োজন একসময় ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্থানীয় শিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী, সাজসজ্জার শ্রমিক, খাবার সরবরাহকারী—সবারই উপার্জনের ক্ষেত্র ছিল এসব আয়োজন।
তবে গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ধারার মধ্যেও সবসময় এক ধরনের নীরব প্রতিযোগিতা ছিল। বাউল, যাত্রা, ওরস বা পালাগানের মতো ধারাগুলোর সঙ্গে ১৯৯০-এর দশক থেকে যুক্ত হতে থাকে ওয়াজ মাহফিল। মতাদর্শগত বিরোধের কারণে ওয়াজের বক্তারা অন্য ধারাগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। তবু সাংস্কৃতিক সহাবস্থান পুরোপুরি নষ্ট হয়নি। বিরোধ ছিল, কিন্তু সেগুলো সামাজিক বোঝাপড়ার স্তরেই আটকে থাকত। মামলা, সংগঠিত হামলা বা শিল্পীদের বিরুদ্ধে দমন–পীড়নের মতো ঘটনা তখন খুব কমই দেখা যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতি ভয়াবহ রকম পাল্টে গেছে। বিরোধ এখন আর মতাদর্শিক পর্যায়ে নেই—ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতায়।
গ্রামবাংলার জনসংখ্যা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনও এই সংকটকে তীব্র করেছে। ২০২২ সালের জনশুমারি বলছে, দেশের মানুষের প্রায় অর্ধেকই গ্রামে থাকে না। শহরে, বিশেষ করে ঢাকাসহ বিভাগীয় নগরগুলোতে বাস করে বিপুলসংখ্যক নাগরিক। বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর অস্তিত্বও গ্রামকে জনশূন্য করে রেখেছে। অর্থাৎ ৮৭ হাজার গ্রামে এখন উপলক্ষ যতই থাকুক, রাতের অনুষ্ঠানে দর্শক খুবই কম। নারী ও শিশুর অংশগ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই সীমিত। ফলে হাজার বছরের যে গ্রামীণ শিল্প–সংস্কৃতি অর্থনীতি চালিয়ে রাখত, তা এখন সংকুচিত হয়ে এসেছে। অল্প পরিসরে উৎসব হলেও দর্শকস্বল্পতার কারণে সেই অর্থনীতি আর টেকসই নেই।
অর্থনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি প্রযুক্তির প্রভাবও গ্রামীণ সংস্কৃতিকে কোণঠাসা করেছে। টেলিভিশন, স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সব মিলিয়ে বিনোদনের নতুন দুনিয়া মানুষকে বাড়িতে আটকে রাখছে। যাত্রাপালা বা পালাগানের মাঠ আর প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। স্থানীয় শিল্পীদের চাহিদা কমছে, তাদের আয়ের পথ সংকুচিত হচ্ছে। একসময় যে পরিসরে সবাই সহাবস্থান করত, সেই পরিসর ছোট হয়ে আসায় এখন তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এই প্রতিযোগিতা কখনো সাংস্কৃতিক বিরোধের আকার নেয়, কখনো প্রকাশ পায় অন্য সাংস্কৃতিক ধারার বিরুদ্ধে অগ্রহণযোগ্য ভাষায়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রতিযোগিতা আর কথা–বিরোধে সীমাবদ্ধ নেই—তা রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতায়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও এই সহিংসতা যুক্ত। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে বিভাজন তৈরি হয়েছিল নানা বিষয়ে—সাম্প্রদায়িকতা–অসাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গি–সেক্যুলার বিভাজন, উন্নয়ন–বিরোধী শক্তির বিভাজন ইত্যাদি। এসব বিভাজনের মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা ধরে রাখা। কিন্তু ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানে তাঁর পতনের পর রাজনীতির যে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, সেখানে ডানপন্থী শক্তি আরও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আন্দোলনের তরুণরা যেভাবে একসময় আশার আলো দেখিয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে রাজনৈতিক ময়দানে এখন একদিকে জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদের ছায়া, অন্যদিকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উত্থান। এই উভয় সংকটের ভেতরেই লোকধারার শিল্পীরা পড়ে গেছেন চরম বিপাকে।
বাউলফকির বা মাজার–সংস্কৃতি সবসময়ই ছিল মানবিকতা, সমন্বয়, সহিষ্ণুতা ও মুক্তচিন্তার ধারক। এ কারণে তারা কখনোই ছিল না ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তির পছন্দের তালিকায়। আজ সেই অপছন্দের জায়গাটিকে ব্যবহার করে গড়ে উঠছে নতুন ধরনের দমন–পীড়ন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় মাত্র পাঁচ মাসে ৪৪টি মাজারে হামলা হয়েছে। বাউল আখড়ায় হামলা, শিল্পীদের ওপর মামলা, এমনকি মৃতদেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসন নীরব থেকেছে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিরোধ দেখা যায়নি। ফলে আক্রমণকারীদের বার্তা ছিল স্পষ্ট—লোকসংস্কৃতির ধারাকে ভয় দেখিয়ে উচ্ছেদ করো।
এটা শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক লক্ষ্য। নবান্নের পর গ্রামে যে সীমিত আয় ঘুরে বেড়ায়, সেই আয়কে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক মজমা হলে স্থানীয় শিল্পীরা কিছু উপার্জন করেন। যদি বাউল, পালা, মাজারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, সেই অর্থনীতি চলে যাবে নতুন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে। অর্থ যার কাছে থাকবে, স্থানীয় রাজনীতিও তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে—এই সরল হিসাবই এখন তীব্র রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণ।
সম্প্রতি আবুল সরকার নামে এক পালাশিল্পীর গ্রেপ্তারের পর তার অনুসারীদের ওপর হামলা, রাজধানীর পল্টনে ‘বাউল সন্দেহে’ এক ব্যক্তিকে মারধর, শাহবাগে প্রতিবাদমন্ত্রে হামলা—সবই একই বার্তার ধারাবাহিকতা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এক পরিবারের গানবাজনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে; ৫০ বছর ধরে চলা তাদের জীবিকা একদিনে আটকে গেছে। স্থানীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে তারা গান শুরু করলেও ভয় এখনও কাটেনি। ভয় নিয়ে গান হয় না—আর ভয়ই এখন লক্ষ্য।
এই ভয় উৎপাদনের রাজনীতি বাউল–ফকিরদের শুধু সামাজিকভাবে একঘরে করছে না, তাদের অর্থনৈতিক অস্তিত্বকেও বিপন্ন করছে। ডানপন্থী শক্তি তাদের দেখে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে। তারা ভোট দেয় না বলে তাদেরকে সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে—মাঝে মাঝে সরিয়ে দিচ্ছে সহিংসতার মাধ্যমে। বাউলদের ওপর হামলা করে কেবল শিল্পী নয়, পুরো সাংস্কৃতিক ধারাকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে: মাঠ ছাড়ো, প্রভাব ছাড়ো, তোমাদের জায়গায় নতুন বয়ান প্রতিষ্ঠা হবে। সেই বয়ান একক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রিত।
এভাবে বহু শতাব্দীর বাংলার যে বহুস্বরিক সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা, তা আজ চরম সংকটে। গ্রামের যে মাটি বাউল-ফকিরদের মানবতার গান শুনে বড় হয়েছে, যে সমাজ পালাগান বা মাজারের আধ্যাত্মিকতায় মানুষ হয়ে উঠেছে, সেই সমাজই আজ ভয়, সন্দেহ, বিভাজন ও সহিংসতার নতুন কাঠামোয় বন্দী। আর আশঙ্কার বিষয় হলো—রাষ্ট্র কিংবা মূলধারার রাজনৈতিক শক্তির কেউই এসব আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে না। বরং নীরবতা যেন ইঙ্গিত করছে, সহিংসতাই এখন স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি–ইতিহাসে এই মুহূর্তটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সাংস্কৃতিক সহাবস্থান ভেঙে গেলে সমাজ কেবল রুচি বা বিনোদনে গরিব হয় না, দুর্বল হয়ে পড়ে তার মানবিক ভিত্তি। বাউল, পালা, মাজার, যাত্রা—এসব শুধু গান বা নাটক নয়; এগুলো মানুষের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে, প্রশ্রয় দেয় ভিন্নতা ও সহযোগিতাকে। আর সেই সংযোগকে ভেঙে ফেলা হলে সমাজ দাঁড়ায় অন্ধ সহিংসতার মাটিতে।
আজ এই সহিংস দমন কেবল শিল্পীদের ওপর নয়—এটি আঘাত হানছে জাতীয় চেতনার ওপর। গণ–অভ্যুত্থানের পর যে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল, তা আবারও ফ্যাসিবাদের ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। যদি এখনই প্রতিরোধ গড়ে না ওঠে, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজকে আবারও দাঁড়াতে হবে এক আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক বাস্তবতার সামনে—যেখানে ভিন্নতা টিকবে না, মানবিকতা জায়গা পাবে না, সংস্কৃতি চলবে জিম্মি হয়ে। আর সমাজের এমন পতনই হতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য।
আপনার মতামত জানানঃ