ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারি দাবি যতই উজ্জ্বল হোক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চোখে ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যানের গুণমান ততটাই প্রশ্নবিদ্ধ। এই বিরূপ মূল্যায়ন নতুন নয়, কিন্তু ২০২৫ সালের আর্টিকেল–IV কনসালটেশন রিপোর্টে যখন আবারও ভারতকে ‘সি গ্রেড’ দেওয়া হলো, তখন জনমত থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন—সব জায়গাতেই প্রশ্ন উঠছে: কেন প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ডেটার মান নিয়ে আইএমএফ এতটা অসন্তুষ্ট? ভারতের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ নাকি পরিসংখ্যান ব্যবস্থার ভেতরের গভীর ত্রুটি—কোনটি বেশি কার্যকর? পুরো বিষয়টি বুঝতে গেলে ভারতের ডেটা অবকাঠামো, পদ্ধতিগত কাঠামো এবং বাস্তব অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সরকারি পরিসংখ্যানের অসামঞ্জস্য একসঙ্গে বিশ্লেষণ করা জরুরি।
আইএমএফ মূলত চারটি গ্রেড ব্যবহার করে—এ, বি, সি এবং ডি—যেখানে ‘এ’ মানে তথ্য যথেষ্ট এবং নির্ভরযোগ্য, আর ‘ডি’ মানে গুরুতর ঘাটতি। ভারত পেয়েছে ‘সি’, যার অর্থ হলো ডেটা আছে, কিন্তু তাতে এমন সব গ্যাপ ও পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে যা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণকে প্রভাবিত করে। এখানে মনে রাখতে হবে, আইএমএফ জিডিপি কত দ্রুত বাড়ছে বা কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় সে বিষয়ে আগ্রহী নয়। বরং তারা খোঁজে: এই জিডিপি গণনা কীভাবে হলো, কোন ডেটার উপর দাঁড়িয়ে, সেই ডেটা কি যথাযথভাবে বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে? ঠিক এখানেই ভারতের সমস্যার শুরু।
ভারত এখনো ২০১১–১২ সালকে ভিত্তিবর্ষ হিসেবে ধরে জাতীয় হিসাব পরিমাপ করে। অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তনের যুগে এক দশকের বেশি পুরোনো ভিত্তিবর্ষ ব্যবহার করা মানে হচ্ছে—অর্থনীতির কাঠামো, ভোগের ধরণ, উৎপাদন ব্যবস্থার রূপান্তর, ডিজিটাল লেনদেন, স্টার্ট–আপ ইকোসিস্টেম, গিগ–ওয়ার্ক, ই–কমার্সের বিস্তার—এসব কিছুই বর্তমান ডেটায় সঠিকভাবে ধরা পড়ছে না। আইএমএফের বক্তব্যও এমনই: ভারত জাতীয় অ্যাকাউন্টসের ব্যাক–এন্ড ডেটা আপডেট করেনি, ফলে বাস্তবতা আর পরিসংখ্যানের মাঝে একটি ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এই ব্যবধান যত বড়, ডেটা তত অবিশ্বস্ত, আর গ্রেডও তত খারাপ।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক বড় পদ্ধতিগত ত্রুটি—ভারত এখনো প্রযোজক মূল্যসূচক (Producers’ Price Index) ব্যবহার করে না, বরং পাইকারি মূল্যসূচক (Wholesale Price Index) দিয়ে অনেক হিসাব চালায়। বিশ্বব্যাপী জিডিপি ডিফ্লেটরের ক্ষেত্রে PPI ব্যবহৃত হয়, কারণ উৎপাদকের দামের পরিবর্তনই অর্থনীতির মূল প্রবাহ নির্দেশ করে। কিন্তু WPI পণ্যের পাইকারি দামের উপর নির্ভরশীল; এর পরিধি সীমিত এবং বহু পরিষেবা ক্ষেত্রই—যা ভারতের জিডিপির বিশাল অংশ—এখানে বাদ পড়ে যায়। ফলে জিডিপি ডিফ্লেটর এবং আসল মূল্যস্ফীতি পরিমাপ বিকৃত হতে পারে। আইএমএফ মনে করছে, এই পুরোনো পদ্ধতি ভারতের জিডিপি পরিমাপকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলছে।
এতো গেল পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা। কিন্তু আরও গভীর একটি সমস্যা তুলে ধরেছে আইএমএফ—তথ্য প্রাপ্যতা এবং সেক্টরাল কভারেজের ঘাটতি। ভারতের অসংগঠিত খাত বা ইনফর্মাল সেক্টর দেশের কর্মসংস্থানের ৭০–৮০ শতাংশ এবং উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী। অথচ এ খাতের আলাদা, স্বাধীন ও নিয়মিত কোনো তথ্য সংগ্রহ বহু বছর ধরেই হচ্ছে না। নোটবন্দি, জিএসটি চালু, এনবিএফসি সংকট এবং কোভিড—এই চারটি বড় ধাক্কা অসংগঠিত খাতকে যে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা অর্থনীতিবিদরা বহুবার বলেছেন। কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানে সেই পতন চোখে পড়ে না—বরং অনেক ক্ষেত্রে সংগঠিত খাতের বৃদ্ধির হারকে মডেল ধরে অসংগঠিত খাতের বৃদ্ধি অনুমান করা হয়। এতে জিডিপি বৃদ্ধির হার বাস্তবের তুলনায় বেশি দেখানোর আশঙ্কা থাকে। আইএমএফও তাই বলছে: ভারতের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস বাস্তব অর্থনীতি, বিশেষত ইনফর্মাল সেক্টরের পরিবর্তন যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে না।
আরো একটি বড় সমস্যা হলো নন–ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান—অর্থাৎ এনবিএফসিগুলো—এবং তাদের সঙ্গে ব্যাংক, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক আন্তঃসংযোগের নির্ভরযোগ্য ডেটার অভাব। ভারতের আর্থিক ব্যবস্থায় এনবিএফসি বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এ খাতে পর্যাপ্ত ও সময়োপযোগী তথ্য নেই, ফলে জিডিপি পরিমাপে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। আইএমএফের ভাষায়, এখানে রয়েছে “সাইজেবল ডিস্ক্রেপেন্সিস”—বড় আকারের অসামঞ্জস্য। এই অসামঞ্জস্যই ‘সি গ্রেড’-এর মূল কারণগুলোর একটি।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে—যদি ডেটা এতই অনির্ভরযোগ্য হয়, তাহলে কীভাবে ভারতের সরকার ৮ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধির দাবি করছে? এখানে দুই ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সরকার বলে—আইএমএফের গ্রেডিং বহু বছর ধরেই একই আছে, এটি কেবল প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন, এতে জিডিপি সংখ্যার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তাদের বক্তব্য—ফ্রিকোয়েন্সি বা তথ্য প্রকাশের নিয়মিততার ক্ষেত্রে ভারত ‘এ গ্রেড’ পেয়েছে, যা অনেক উন্নত দেশের কাছেও নেই। এই যুক্তির বিপরীতে বিরোধী দলগুলোর দাবি—আইএমএফ সরাসরি বলেছে ‘ডেটা ঘাটতি’ রয়েছে, যা পরিসংখ্যানের মান প্রশ্নবিদ্ধ করে। কংগ্রেসের অভিযোগ—সংগঠিত খাতের বৃদ্ধিকে অসংগঠিত খাতের বৃদ্ধির সমান ধরে নেওয়াই জিডিপি বাড়িয়ে দেখানোর প্রধান পদ্ধতি।
অর্থনীতিবিদরাও একই ধরনের মত দিয়েছেন। অধ্যাপক অরুণ কুমার যেমন বলেন—২০১১–১২ সিরিজ সরকার নিজেই একসময় মেনে নেয়নি, সেখানে পরে আবার সেটাই গণনার ভিত্তি হিসেবে টিকে গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, নোটবন্দির সময় তিন লক্ষ শেল কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলেও জিডিপি ডেটায় তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। পরিষেবা খাতের জরিপে অনেক কোম্পানির অস্তিত্বই মিলছে না, তবু পরিসংখ্যানে তারা যুক্ত থাকছে। এই সব অসামঞ্জস্যের মধ্যেই আইএমএফের ‘সি গ্রেড’-এর ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে।
আরও একটি দৃষ্টিকোণ ওঠে আসে—ভারতের মতো দ্রুত রূপান্তরমান অর্থনীতির জন্য ডেটা আপডেটের গতি অত্যন্ত ধীর। আদমশুমারি ২০১১ সালের পর আর হয়নি, শ্রমবাজার বিষয়ক স্বতন্ত্র ও স্বচ্ছ জরিপের অভাব রয়েছে, ভোগব্যয়ের বড় জরিপ ২০১৭–১৮ সালে বাতিল করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে, ফলে ইনকাম–কনজাম্পশন সম্পর্কিত বড় ছবি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির বিশাল অংশই ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে, কিন্তু পরিসংখ্যান ব্যবস্থা সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে না।
তবে এর মধ্যেও রাজনৈতিক রং যুক্ত হয়ে গেছে। কংগ্রেস বলছে—বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির, মূলধন গঠন বাড়ছে না, সংগঠিত খাতে বড় কোম্পানির সাফল্যকে পুরো অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখানো ভুল। বিজেপি পাল্টা বলেছে—এই অভিযোগ পুরোটাই পক্ষপাতদুষ্ট; ভারতের প্রবৃদ্ধির গল্প বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্র, তাই বিরোধীরা এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তারা আরও বলে—২০২২–২৩ সালে নতুন ভিত্তিবর্ষে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে; তখন ডেটা আরও আধুনিক হবে।
কিন্তু ভারত কি সত্যিই কেবল পদ্ধতিগত কারণে এই গ্রেড পেয়েছে? না কি এর আড়ালে বাস্তব অর্থনীতি ও সরকারি পরিসংখ্যানের মধ্যে একটি দূরত্ব আছে? বিশেষজ্ঞ এমকে বেণুর মতে—সরকার গত পাঁচ–ছয় বছর ধরে তথ্যকে ‘ম্যানেজ’ করছে। সংগঠিত খাতের ডেটা সহজলভ্য; সেখানে বৃদ্ধি বাস্তব। কিন্তু অসংগঠিত খাত ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে, যা সরকারের জিডিপি পরিমাপ পদ্ধতিতে ধরা পড়ে না। এ কারণে জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রকৃত অবস্থার চেয়ে বেশি দেখানো সম্ভব হয়। আইএমএফের ‘সাইজেবল ডিস্ক্রেপেন্সিস’ মন্তব্যের ইঙ্গিতও এই দিকেই।
তবে পুরো বিষয়টি কেবল অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নয়—এটি আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির সঙ্গেও যুক্ত। ভারত এখন বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল বড় অর্থনীতির একটি, এবং নিজেদের একটি ‘ডেটা–ড্রিভেন’ বিশ্বনেতা হিসেবে তুলে ধরতে চায়। সে অবস্থায় আইএমএফের ‘সি গ্রেড’ ভারতের পরিসংখ্যান ব্যবস্থার প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নিতে ডেটার উপরই নির্ভর করেন, এবং ডেটার গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ঝুঁকির হিসাবও পাল্টে যায়। সরকারের কাছে তাই এই গ্রেড শুধু প্রযুক্তিগত মন্তব্য নয়—বরং এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে।
সবশেষে এসে দাঁড়ায় একটি বড় প্রশ্ন—ভারতের ডেটা ব্যবস্থা কি যুগোপযোগী রূপ পাবে? কি হবে ডেটার কাভারেজ, নিয়মিততা এবং আধুনিকীকরণ? আদমশুমারি হবে কবে, নতুন ভিত্তিবর্ষ কবে নির্ধারিত হবে, PPI কবে প্রবর্তিত হবে—এই প্রশ্নগুলোর জবাবই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতে ভারতের পরিসংখ্যানের গুণমান কতটা উন্নত হবে। প্রবৃদ্ধির গল্প যতই শক্তিশালী হোক, তা নির্ভর করে থাকে তার মাপজোখের নির্ভুলতার উপর। আর সেখানেই ভারতকে নতুন করে ভাবতে হবে—কারণ জিডিপি কেবল একটি সংখ্যা নয়, বরং অর্থনীতির স্বাস্থ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড।
এই পুরো বিতর্কের সারকথা হলো—ভারতের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, কিন্তু সেই বৃদ্ধিকে মাপার পদ্ধতি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। আইএমএফের ‘সি গ্রেড’ সেই অসামঞ্জস্যের প্রতিচ্ছবি। উন্নয়নকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হলে ডেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে—এটাই সম্ভবত ভারতের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আপনার মতামত জানানঃ