রাজধানীর পল্লবীর সেই ব্যবসায়ীর পায়ের গুলির শব্দ শুধু তার শরীরকে পঙ্গু করেনি, নীরবে পুরো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আর সাধারণ মানুষের বুকের ভেতরও এক ধরনের স্থায়ী আতঙ্ক গেঁথে দিয়েছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন শহর ও পেশার মানুষের অভিজ্ঞতা শুনলেই মনে হয়, চাঁদাবাজি এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো অপরাধ নয়; এটি যেন দেশের অর্থনীতি ও সমাজজীবনের ওপর ছড়িয়ে পড়া এক অদৃশ্য মহামারি।
রাজনীতির বড় পটপরিবর্তনের পর ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক, শ্রমিক, এমনকি রাজনৈতিক নেতাদেরও টার্গেট করা শুরু হয়েছে নতুন করে। বড় বড় কারখানা থেকে শুরু করে ফুটপাতের ক্ষুদ্র দোকান—সবখানেই একই কণ্ঠস্বর, ‘চাঁদা না দিলে ব্যবসা বন্ধ, হামলা, মামলা বা খুনের হুমকি।’ চট্টগ্রামের ইপিজেড অঞ্চলে রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা পরিচালনাকারী উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে শহরের এক নারী উদ্যোক্তা—দুজনের ভয়ই এক: মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হবে, নইলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি জীবনও নিরাপদ থাকবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিকল্পিত অপপ্রচার থেকে শুরু করে সরাসরি হত্যার হুমকি—চাঁদা আদায়ের কৌশল এখন বহুমাত্রিক, পরিণত ও সংগঠিত।
রাজধানীর বিভিন্ন মোড়, বাজার বা যেকোনো ব্যস্ত এলাকায় কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলে বোঝা যায় চাঁদাবাজি কতটা খোলামেলা আর নিয়মিত। কারওয়ান বাজারের মসলার ব্যবসায়ী, গুলিস্তানের ফুটপাতের দোকানদার, নিউমার্কেট, মিরপুর, তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী বা পুরান ঢাকার ভ্রাম্যমাণ হকার—তাঁদের ভাষা আলাদা হলেও অভিজ্ঞতা প্রায় একই। প্রতিদিন ১০০ থেকে ৫০০ টাকা গুনে দিতে হয় বিভিন্ন দল আর গোষ্ঠীর নামে। কোনো কোনো এলাকার হকার নেতারা অকপটে স্বীকার করেন, দিনশেষে বিপুল অঙ্কের টাকা চলে যায় চাঁদাবাজদের হাতে, অথচ এর কোনো অংশই আইনগত বা সরকারি কোনো ভ্যাট বা করের আওতায় পড়ে না।
এভাবে প্রতিটি বাজার, রাস্তা, পার্কিং, টার্মিনাল কিংবা আবাসিক এলাকার গলি ধরে হিসাব কষলে যে অঙ্ক দাঁড়ায়, তা দেশের জাতীয় অর্থনীতির জন্যও এক বড় রক্তক্ষরণ। পণ্যে পণ্যে যে অতিরিক্ত দাম সাধারণ মানুষকে দিতে হচ্ছে, তার আড়ালে কোথাও না কোথাও যুক্ত আছে এই অবৈধ চাঁদা। পরিবহন খাতে, বিশেষ করে ঢাকার ৫০-৬০টি বড় টার্মিনাল ও স্ট্যান্ডে প্রতিদিন যে অঙ্কের টাকা ওঠে, তা কোটি ছাড়িয়ে যায় সহজেই। মাস শেষে তা পরিণত হয় কয়েক শ কোটি টাকার এক গোপন অর্থনীতিতে, যেখানে কোনো সরকারি নজরদারি নেই, নেই কোনো সামাজিক জবাবদিহিও।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মাঝে মাঝেই পুলিশি অভিযান, গ্রেপ্তারের সংবাদ, ‘শূন্য-সহিষ্ণু’ বার্তা আমরা শুনি। কিন্তু বাস্তবতার সাথে তার ফারাক স্পষ্ট। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ স্বীকার করছে, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় পুরনো চাঁদাবাজ চক্রগুলো দুর্বল হয়ে পড়ার পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করছে নতুন কিছু গোষ্ঠী। তারা অনেকেই রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করছে, কেউ আবার নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বা গোষ্ঠীর পরিচয় নিয়ে মাঠে নেমেছে। স্থানীয় পর্যায়ে যাদের আগে শুধু ‘দাপুটে’ লোক বলা হতো, তারাও এখন রাজনৈতিক পরিচয়ের আবরণে নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে চাঁদা তোলা শুরু করেছে।
সংখ্যার হিসাবও কম উদ্বেগজনক নয়। রাজধানীমুখী পুলিশের নথিতে আছে আড়াই হাজারের বেশি চিহ্নিত চাঁদাবাজের নাম। দেশের প্রতিটি জেলায় থানাভিত্তিক তালিকা মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে অর্ধলক্ষাধিক সন্ত্রাসী বা চাঁদাবাজের সংখ্যা, যাদের অনেকেই আবার নতুন নাম। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, গত কয়েক মাসে দুই হাজারের বেশি চাঁদাবাজির ঘটনা যাচাই করতে হয়েছে তাদের, যার বড় একটি অংশেই দেখা গেছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জড়িত থাকার প্রমাণ। অথচ এই অভিযানের মধ্যেই আবার নতুন নতুন চক্র উঠে আসছে; যেন এক দলকে ধরলে আরেক দল আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে।
চাঁদা না দিলে পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তার নজির ছড়িয়ে আছে গত ১৪ মাসের হত্যাকাণ্ডের খবরে। নানা সূত্রের তথ্য বলছে, চাঁদা নিয়ে বিরোধ বা চাঁদাবাজির চাপ সামলাতে না পেরে দেশে শতাধিক মানুষ খুন হয়েছে। রাজধানীতে অন্তত ২০টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে সরাসরি চাঁদা নিয়ে দ্বন্দ্বকে ঘিরে। কেবল টিভি নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট লাইন, গ্যারেজ, মার্কেটের দোকান বরাদ্দ কিংবা স্থানীয় প্রভাব বিস্তার—প্রতিটি ক্ষেত্রেই দখল আর চাঁদাই এখন প্রধান নিয়ামক। একেকটি এলাকায় বর্তমান শীর্ষ সন্ত্রাসী বা তার সহযোগী গোষ্ঠীকে না চেনা মানে সেখানে নিরাপদে ব্যবসা বা বাস করতে না পারা।
এসব ঘটনার ভুক্তভোগীদের তালিকা দেখলে দেখা যায়, শুধু ছোটখাটো ব্যবসায়ী বা ট্রাকচালকই নন, বড় রাজনৈতিক পরিবারের লোকজনও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। জাতীয় পর্যায়ের একজন প্রয়াত নেতার পরিবারের সদস্যকে পর্যন্ত থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে হয়েছে, কারণ তাদের ওপরও চাপ ছিল মোটা অঙ্কের চাঁদা দেওয়ার। গাড়ি বিক্রেতা, আমদানিকারক, রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ডিলারদের সংগঠনগুলো পর্যন্ত রাস্তা ও বাজারে মানববন্ধনে নেমে বলেছে—চাঁদাবাজি না থামলে তাঁরা গাড়ি বেচাকেনা ও রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করে দেবেন। হোয়াটসঅ্যাপে অস্ত্রের ছবি পাঠিয়ে ভয় দেখানো থেকে শুরু করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ককটেল হামলা—সবই এখন পরিচিত প্যাটার্ন।
আইনের বইয়ে চাঁদাবাজি একটি ফৌজদারি অপরাধ; আর বাস্তবে এটি পরিণত হয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটে। ডিএমপি কমিশনার স্বীকার করেছেন, চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, সাধারণ মানুষ কষ্টে পড়ছে। বাজারের প্রতিটি স্তরে ব্যবসায়ীরা যখন অতিরিক্ত খরচ বহন করতে বাধ্য হন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা পণ্যের মূল্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে একজন হকার যেদিন ৩০০ টাকা চাঁদা দেন, সেদিন তার পণ্যে লাভ তুলতে তিনি ভোক্তার কাছ থেকে বাড়তি দাম নেবেনই। এই অদৃশ্য কর বা অবৈধ ট্যাক্সের বোঝা শেষ পর্যন্ত চাপছে ভোক্তার ঘাড়েই।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের আন্দোলন ও সরকার পরিবর্তনের পর যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, সেই সময়টি নতুন চাঁদাবাজ গোষ্ঠীগুলোর জন্য ছিল এক ধরনের ‘গোল্ডেন টাইম’। তখন প্রশাসনিক কাঠামো অনেকটাই ব্যস্ত ছিল রাজনৈতিক সঙ্কট আর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে। সেই সুযোগে বিভিন্ন এলাকায় যারা আগে ছোটখাটো দাপট দেখাত, তারা রাজনৈতিক পরিচয় জোগাড় করে বা নতুন গোষ্ঠীর ব্যানারে নিজেদের বিকশিত করেছে। পাশাপাশি পুরনো সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ কারাগার থেকে বের হয়ে আবার একই ব্যবসায় ফিরে এসেছে, কারণ তাদের কাছে এটি ‘পরীক্ষিত’ আয়ের উৎস।
চাঁদাবাজির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে গোয়েন্দারা কয়েকটি গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করেছেন—রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একাংশ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দুষ্ট উপাদান, প্রশাসনের ভেতরে কিছু সুবিধাবাদী কর্মকর্তা, স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্যাং এবং পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে গড়ে ওঠা কথিত নেতারা। এরা প্রত্যেকে নিজেদের এলাকায় শক্ত প্রভাব ধরে রাখতে চাইছে, ফলে একই জায়গায় একাধিক চক্রের সংঘর্ষও বাড়ছে। কোথাও ব্যবসায়ীকে একদল টাকা দিতে বলছে, আবার আরেকদল এসে বলছে তাদেরও দিতে হবে। মাঝখানে পড়া সাধারণ ব্যবসায়ী বা শ্রমিকের সামনে তখন দুটো পথ—অথবা টাকা দাও, অথবা প্রাণ ও সম্পদের ঝুঁকি নাও।
হাট-বাজার, বাসস্ট্যান্ড, ফেরিঘাট কিংবা আবাসিক এলাকার নির্মাণকাজ—সব জায়গাতেই এখন চাঁদার হিসাব আগেই ধরে নিতে হয়। অনেক বাজারে দোকানপ্রতি প্রতিদিন নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হয় স্থানীয় একদল ‘কর্তাব্যক্তিকে’। কোনো কোনো জায়গায় ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, পরিচ্ছন্নতা ফি ইত্যাদি নামে রসিদও দেওয়া হয়, কিন্তু সেই টাকা কতটা সরকারি খাতে যায়, আর কতটা ব্যক্তিগত পকেটে জমা হয়, তার কোনো স্বচ্ছতা নেই। যারা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন, তাঁদের দোকানে হঠাৎ সিলগালা, পথে হয়রানি, এমনকি মারধরের শিকার হতে হয়।
একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে এক ধরনের নিরুপায় মানসিকতাও তৈরি হচ্ছে। অনেকেই ভাবছেন, থানায় অভিযোগ করলেও লাভ নেই, উল্টো ঝামেলা বাড়তে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, চাঁদাবাজদের সঙ্গে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সখ্যের কথা। ফলে ভুক্তভোগী মনে করেন, আইনের আশ্রয়ে গেলে তাঁর নাম-ঠিকানাও আবার সেই চক্রের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। এই ভয় চাঁদাবাজদের ব্যবসাকে আরও নিরাপদ করে তুলছে।
অর্থনীতির ভাষায় যা হচ্ছে, তা এক ধরনের ‘পলিটিকাল এক্সটরশন ইকোনমি’—রাজনৈতিক ক্ষমতার বদলে গিয়ে শুধু পতাকা আর নেতা বদলাচ্ছে, কিন্তু চাঁদাবাজি নামের ব্যবসার ধরন ও কাঠামো একই থাকছে। একজন অর্থনীতিবিদ ঠিকই বলেছেন, ক্ষমতা পরিবর্তনের পরে রাজনৈতিক সমঝোতা জটিল হলেও চাঁদাবাজির সমঝোতা খুব সহজ; পুরনো চক্র সরে গেলে নতুন চক্র আসে, টাকার স্রোত থামে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেই সব উদ্যোক্তা, যারা কর্মসংস্থান তৈরি করছেন, দেশের জন্য রপ্তানি আয় করছেন, আবার ভোক্তাও যাঁরা দিনের শেষে বাজারে গিয়ে সব কিছুর বাড়তি দাম গুনছেন।
এই ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়, কিন্তু একেবারেই অসম্ভবও নয়। প্রথমত প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য—চাঁদাবাজি যে কোনো দলের হলে তা অগ্রহণযোগ্য; ক্ষমতায় থাকুক বা বাইরে থাকুক, কেউ চাঁদাবাজকে আশ্রয় দেবে না—এমন বার্তা এবং বাস্তব পদক্ষেপ দেখতে চায় মানুষ। দ্বিতীয়ত দরকার পুলিশের ভেতরের দুর্নীতিগ্রস্ত অংশকে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি দেওয়া, যাতে ভুক্তভোগী থানায় গিয়ে অন্তত নিরাপদ বোধ করেন। তৃতীয়ত ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোরও উচিত, সুবিধাবাদী লোকজনকে সামনে রেখে ক্ষমতা ভোগ করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের সদস্যদের সুরক্ষার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া।
সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষের ভয়ের সংস্কৃতিকে ভাঙা জরুরি। যে ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে দিতে ক্লান্ত, যে শ্রমিক পথেঘাটে টাকা দিয়ে বেঁচে থাকাকে নিজের ভাগ্য মনে করছে, যে অভিভাবক সন্তানের স্কুলের পথে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে—তাদের পাশে দাঁড়ানোই হতে পারে এই মহামারি থামানোর প্রথম ধাপ। নইলে আজ পল্লবীর এক দোকানদার গুলিবিদ্ধ, কাল হয়তো আরেকজন উদ্যোক্তা রাতের আঁধারে নির্মমভাবে খুন—খবরের কাগজের পাতায় নাম বদলাবে, কিন্তু গল্পের কাঠামো একই থাকবে। আর প্রতিদিন সকালে শেয়ারবাজারের উত্থান-পতনের হিসাবের আড়ালেও তখন লুকিয়ে থাকবে এই ভয়ের অর্থনীতি, যেখান থেকে কেউ আসলে নিরাপদ থাকছে না।
আপনার মতামত জানানঃ