লন্ডনের ঠান্ডা নভেম্বরের এক দিন। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল মার্কেটের হলজুড়ে তখন পর্যটন–খাতে রঙিন স্টল, হাসি, ছবি তোলার ভিড়। এই ভিড়ের মাঝেই ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক অস্বস্তিকর কিন্তু ঐতিহাসিক মুহূর্ত—ইসরায়েলের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মাইকেল ইজহাকভের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেখবাজ শরিফের পর্যটন উপদেষ্টা সারদার ইয়াসির ইলিয়াস খানের করমর্দন। খুব ছোট, আনুষ্ঠানিক–ধরনের এই ‘হ্যান্ডশেক’ হঠাৎ করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ঝড় তোলে, ইসলামাবাদ দ্রুত জানায়—এটি সরকার অনুমোদনহীন ব্যক্তিগত আলাপ। কিন্তু যে দেশের পাসপোর্টেই লেখা থাকে “ইসরায়েল ব্যতীত বিশ্বের সব দেশে বৈধ”, সেখানে এ ধরনের যেকোনো ছবি শুধু প্রটোকল ভাঙা নয়, একটি ভূরাজনৈতিক সিগন্যালও বটে।
এই ছবিটা একা নয়। কিছু মাস আগেই বেসরকারি উদ্যোগে পাকিস্তানি সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের একটি প্রতিনিধি দল গোপনে ইসরায়েল সফর করে—শরাকা নামের সংগঠনের সহায়তায়, পাসপোর্টে স্ট্যাম্প না দিয়েই, যেন দেশে ফিরেই আইনগত ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়া যায়। একই বছরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে আমেরিকান জিউইশ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল রোজেনের নীরব দেখা হওয়ার খবরও বিভিন্ন কূটনৈতিক মহলে ঘোরে; কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও অস্বীকারও করে না। উপর ওপর এগুলো ছোট, বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও, রেখা টেনে দেখলে বোঝা যায়—ওয়াশিংটন, ইসলামাবাদ আর তেল–আবিবকে নিয়ে এক নতুন ত্রিভুজ আঁকা হচ্ছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে গাজা যুদ্ধের পরবর্তী আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাস ও তথাকথিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস ২.০’।
পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবে নিজেকে ফিলিস্তিন ইস্যুর অন্যতম বড় রক্ষক হিসেবে তুলে ধরে এসেছে। রাষ্ট্রীয় বক্তব্যে, স্কুলের পাঠ্যবইয়ে, মসজিদের খুতবায়—সব জায়গাতেই “জায়োনিস্ট দখলদারত্বের” বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বরকে ধর্মীয় ও কৌশলগত দায়িত্ব হিসেবে আঁকা হয়েছে। পাকিস্তানি পাসপোর্টে ইসরায়েলের নাম বাদ দেওয়া শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, আইডেন্টিটি–পলিটিক্সের অংশ। এমন এক রাষ্ট্রের দিকে এখন যদি ইসরায়েল–স্বীকৃতির চাপ বাড়ে, সেটি শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রশ্ন নয়; মুসলিম বিশ্বের জনমত, পারমাণবিক ভারসাম্য ও আরব–দক্ষিণ এশিয়া অক্ষের ভবিষ্যৎ–সবকিছুর ওপর এর প্রভাব পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে যে ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ এগিয়ে নিচ্ছে, তার মূল তিনটি স্তম্ভ—গাজা যুদ্ধের একটা ব্যবস্থাপত্র করা, আব্রাহাম অ্যাকর্ডসকে বিস্তৃত করা, আর চীন–ইরান–রাশিয়া অক্ষের প্রভাব ঠেকিয়ে রাখা। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ঘোষিত ২০ দফা গাজা পিস প্ল্যান এবং সেই ভিত্তিতে হওয়া অস্ত্রবিরতি–চুক্তি এখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেরও অনুমোদন পেয়েছে। এই পরিকল্পনার কেন্দ্রে আছে গাজা ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজিশনাল অথরিটি—একটি বহুজাতিক তত্ত্বাবধায়ক কাঠামো, যেখানে আরব ও মুসলিম সেনা–পুলিশ মোতায়েনের প্রস্তাব রয়েছে। পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক সক্ষম, বৃহৎ সেনাবাহিনী–সম্পন্ন ও অভিজ্ঞ শান্তিরক্ষী বাহিনী–পাঠানো রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের কাঠামোতে অংশগ্রহণ একদিকে সম্মান ও প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ, অন্যদিকে বিপজ্জনক রাজনৈতিক ঝুঁকি।
এই প্রেক্ষাপটে শারম আল–শেখের গাজা পিস সামিট একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে ওঠে। মিশরের সমুদ্রঘেঁষা সেই শহরে ১৩ অক্টোবর বসা সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ উপস্থিত ছিলেন, একাধিক বিশ্বনেতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ইসরায়েল ও হামাসের কোনো প্রতিনিধি সেখানে না থাকায় অনেক বিশ্লেষক এটিকে প্রতীকী সভা বললেও, বাস্তবে এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি–বয়ানকে বৈধতা দেওয়ার এবং ‘দায়িত্বশীল মুসলিম রাষ্ট্র’ হিসেবে পাকিস্তানকে সামনে আনার এক বড় মঞ্চ। শেহবাজ শরিফ ট্রাম্পের “শান্তির উদ্যোগ”কে প্রকাশ্যে অভিনন্দন জানান এবং গাজা–পরবর্তী পুনর্গঠনে পাকিস্তানের ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন—যা দেশের ভেতরে গাজা–সংহতির আবেগকে সন্তুষ্ট করার সাথে সাথে ওয়াশিংটনের পরিকল্পনায়ও পাকিস্তানকে অপরিহার্য অংশীদার হিসেবে তুলে ধরে।
তবে পুরো চিত্রটা বোঝার জন্য শুধু কূটনৈতিক শীর্ষ সম্মেলন দিয়ে শুরু করলে চলবে না; রাস্তার রাজনীতিও পড়তে হবে। গাজা যুদ্ধের দুই বছরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বে যে পরিমাণ জনমত সংগঠিত হয়েছে, তা রেকর্ডভাঙা—বহু শহরে লাখো মানুষের মিছিল, বন্দর অবরোধ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিভেস্টমেন্ট আন্দোলন, আইনি চ্যালেঞ্জ, বয়কট–ক্যাম্পেইন—সব মিলিয়ে এক ধরনের নাগরিক বিদ্রোহের আবহ তৈরি হয়েছে। একই সময়ে ইউরোপ জুড়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ এতটাই বেড়েছে যে, একের পর এক দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে। প্রথমে স্পেন–আয়ারল্যান্ড–নরওয়ে, এরপর ২০২৫ সালে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, অ্যান্ডোরা, পরে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ মোট ১৫০–এর বেশি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি স্থগিত করা, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও বাণিজ্য সুবিধা কাটছাঁটের মতো পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা চলছে।
এই পরিবর্তিত দৃশ্যে যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি সমীকরণ দাঁড় করাতে চাইছে, যেখানে একদিকে ইসরায়েল–বিরোধী চাপকে কিছুটা সুষম করা যায়, অন্যদিকে ‘দায়িত্বশীল মুসলিম মিত্র’দের সামনে এনে বলা যায়—দেখো, তোমরাই তো এখন শান্তির অংশীদার। পাকিস্তানকে এই ক্লাবে তোলার পেছনে কয়েকটি কৌশলগত হিসাব রয়েছে। প্রথমত, এটি একমাত্র মুসলিম পারমাণবিক শক্তি, যার সামরিক ও গোয়েন্দা সক্ষমতা গালফ থেকে আফগান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ধর্মীয় অনুভূতি ও জমায়েত–রাজনীতির প্রভাব এত বেশি যে, একবার যদি তারা ইসরায়েল–স্বীকৃতির পথে হাঁটে, তবে তা অনেক মুসলিম সমাজে “হারাম জিনিসকে হালাল করা”র শক্তিশালী দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। তৃতীয়ত, আফগানিস্তান থেকে আরব উপসাগর পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে ইরানবিরোধী নিরাপত্তা স্থাপনায় পাকিস্তানকে যুক্ত করা হলে তা সৌদি–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তির মতো উদ্যোগের সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন নিরাপত্তা জাল তৈরি করতে পারে—যাকে অনেকে আপাতত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস ২.০’ বলে ডাকছেন।
এদিকে পাকিস্তানের ভেতরেও দৃশ্যপট একেবারে সরল নয়। গাজা ইস্যুতে তেহরিক–ই–লাব্বাইক পাকিস্তানের মতো দলগুলো রাস্তায় নেমে তীব্র বিক্ষোভ করেছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণও গেছে কয়েকজনের। ট্রাম্পের ঘোষিত গাজা–যুদ্ধ–বিরতির পর অনেকে এটাকে “ফিলিস্তিনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা” হিসেবে তুলে ধরেছে, বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধ থেমে গেলেও গাজা মূলত ধ্বংসস্তূপ আর যুদ্ধ–পরবর্তী ‘শান্তি–শৃঙ্খলা’ নামের নতুন এক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ল্যাবরেটরিতে পরিণত হচ্ছে। পাকিস্তানি ইসলামপন্থী দলগুলো তাই সরকারের যেকোনো নরম ইঙ্গিত—হোক সেটা শারম আল–শেখে অংশগ্রহণ, হোক লন্ডনের কোনো মেলায় ইসরায়েলি কর্মকর্তার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা—সবকিছুকেই ‘স্লিপারি স্লোপ’ হিসেবে দেখছে।
সরকারি দিক থেকে অবশ্য এখনো একটি পরিষ্কার লাল রেখা টেনে রাখা হয়েছে—ইসলামাবাদ বারবার বলেছে, দুই–রাষ্ট্র সমাধান, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এবং ১৯৬৭–পূর্ব সীমান্তে ফিরে যাওয়ার কোনো অগ্রগতি ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতির প্রশ্নই ওঠে না। গাজা পিস সামিটেও পাকিস্তান নিজেদের অংশগ্রহণকে “ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের সমর্থন” হিসেবে তুলে ধরেছে, যেন কেউ এটাকে স্বাভাবিকীকরণের সিঁড়ির প্রথম ধাপ বলে ধরে না নেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতির অভিজ্ঞতা বলে, কখনো কখনো প্রতীকী অংশগ্রহণই ভবিষ্যতের বড় নীতিগত পরিবর্তনের ‘ড্রাই রান’ হয়ে দাঁড়ায়—যেখানে আগে আচরণ বদলায়, পরে বদলায় নীতি।
ওয়াশিংটনের চোখে পাকিস্তানের সঙ্গে ইসরায়েলের সীমিত যোগাযোগও একটি ‘টেস্ট কেইস’। পর্যটন, বাণিজ্য মেলা, সাইডলাইনের বৈঠক—এসব জায়গায় ছোট ছোট যোগাযোগ ঘটিয়ে আসলে বোঝা হচ্ছে, পাকিস্তানি সমাজ কত দ্রুত ক্ষুব্ধ হয়, সেনাবাহিনী কতটা নমনীয়, বিরোধী দলগুলো কী তীব্রতা নিয়ে রিঅ্যাক্ট করে, আর আন্তর্জাতিক মহল কীভাবে সাড়া দেয়। লন্ডনের হ্যান্ডশেকের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেমন ঝটপট জানিয়ে দিল—এটা অনুমোদিত ছিল না, সরকার জানতই না—তাতে একদিকে ঘরোয়া ক্ষোভ সামলানো গেল, কিন্তু অন্যদিকে দ্বিতীয়বারও বোঝানো হলো, দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ হয়তো একেবারেই অসম্ভব নয়, অন্তত বেসরকারি বা ‘অননুমোদিত’ পর্যায়ে।
প্রশ্ন হলো, এই সম্ভাব্য স্বীকৃতির পথে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত হাঁটবে কি? এর উত্তরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু বড় সমীকরণ। অর্থনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তান এখন ভয়াবহ চাপের মধ্যে; আইএমএফ–ঋণের শর্ত, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে ইসলামাবাদ প্রায় স্থায়ীভাবে দাতা–দেশ ও গালফ সঙ্গীদের আশ্বাসে বাঁচে। গালফের কয়েকটি রাষ্ট্র ইতোমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ করেছে, আরও অনেকে করছেন—কিন্তু তারা তেলের অর্থে স্বয়ংসম্পূর্ণ, মুসলিম জনমতকে সামাল দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় মেশিনারিও তাদের হাতে শক্তিশালী। পাকিস্তানের হাতে সেই বিলাসিতা নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি গাজা–পরবর্তী নিরাপত্তা কাঠামোয় পাকিস্তানের সামরিক অংশগ্রহণ বা ইসরায়েল–স্বীকৃতির বিনিময়ে অর্থনৈতিক–রাজনৈতিক সুরাহা প্রস্তাবও করে, তার দাম ইসলামাবাদে গিয়ে পড়বে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর।
তারপরও পাকিস্তানের কিছু কৌশলগত লাভের সম্ভাবনাও আছে, যা ইসলামাবাদ উপেক্ষা করতে পারবে না। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের দরজায় হাত রাখলে পাকিস্তান একদিকে ওয়াশিংটনের কাছে আবারও ‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার’ হিসেবে নিজ অবস্থান মজবুত করতে পারবে, অন্যদিকে সৌদি–ইউএই–কাতারসহ গালফ অক্ষের নিরাপত্তা স্থাপত্যেও নিজের জায়গা শক্ত করতে পারবে। এ ছাড়া ভারত–ইসরায়েল সামরিক সহযোগিতা যত গভীর হচ্ছে, পাকিস্তানের কিছু মহল মনে করে, তেল–আবিবের সঙ্গে অন্তত সীমিত যোগাযোগ থাকলে নিউ দিল্লি–তেল–আবিব অক্ষকে ব্যালান্স করার নতুন কূটনৈতিক দর–কষাকষির সুযোগ তৈরি হতে পারে।
সবচেয়ে বড় প্রতীকী প্রশ্নটি অবশ্য মুসলিম জনমতকে ঘিরে। গাজা যুদ্ধের সময়কার নির্যাতনের ছবি, শিশুদের লাশ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত আশ্রয়কেন্দ্র—এসবের বিরুদ্ধে যে বৈশ্বিক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলিম তরুণ প্রজন্মের হাতে–কলমে রাজনৈতিক চেতনায় রূপ নিয়েছে। পাকিস্তান যদি ঠিক এই সময়েই ইসরায়েলের দিকে হাত বাড়ায়, তাহলে তা বিশ্ব মুসলিম জনমতের এক বড় অংশের কাছে ‘গাজার শহীদদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবেই ধরা পড়বে। আবার অন্য এক অংশ এটিকে বাস্তববাদী রাজনীতির উদাহরণ হিসেবে দেখতেও পারে, যেখানে যুক্তি হবে—টেবিলে বসে দাবি আদায় করা, বাইরে থেকে স্লোগান দেওয়ার চেয়ে বেশি কার্যকর। সেই বিতর্ক একবার শুরু হলে তা শুধু পাকিস্তানের ভেতরে নয়, কায়রো থেকে কুয়ালালামপুর পর্যন্ত পুরো মুসলিম অঙ্গনের মধ্যে ঢেউ তুলবে।
সবশেষে ফিরে আসা যাক শুরুতে উল্লেখ করা লন্ডনের ছোট্ট করমর্দনে। হাতে ফুলকপি নয়, পর্যটন–মেলার ব্রোশিওর। তবু ছবিটির গুরুত্ব অনেক বেশি, কারণ এটি দেখাচ্ছে—প্রতীকী অঙ্গভঙ্গি দিয়ে কীভাবে ধীরে ধীরে ‘অসম্ভব’ দৃশ্যকে ‘সম্ভব’ করে তোলা হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আপাতত দ্বৈত ভাষা ব্যবহার করছে—একদিকে গাজার জন্য কড়া ভাষায় বিবৃতি, শারম আল–শেখে আবেগঘন বক্তৃতা; অন্যদিকে পর্দার আড়ালে সীমিত যোগাযোগ, ট্র্যাক–টু ডায়ালগ, পর্যটন–মেলায় সৌজন্য–সাক্ষাৎ। যুক্তরাষ্ট্র এই দ্বৈততা জানে, এমনকি এর সুবিধাও নিচ্ছে—কারণ তার কাছে সবচেয়ে জরুরি হলো, গাজা–পরবর্তী আঞ্চলিক আর্কিটেকচারে সব পক্ষকে এমন এক বিন্দুতে দাঁড় করানো, যেখানে ইসরায়েলের নিরাপত্তা, পশ্চিমা কূটনৈতিক সুবিধা ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রতীকী মর্যাদা—সবকিছু একসঙ্গে সামলে নেওয়া যায়।
পাকিস্তানের সামনে তাই আজ এক জটিল পরীক্ষার খাতা খোলা। এক পাশে ইসলামি সংহতি, ফিলিস্তিন ইস্যুর নৈতিক দায়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উত্তাপ; অন্য পাশে নিরাপত্তা, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গ্লোবাল মঞ্চে ‘গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়’ হয়ে ওঠার লোভ। এই ভারসাম্য–অভিযানের ফল এখনই জানা না গেলেও, একটা বিষয় পরিষ্কার—ইসরায়েল প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ এখন শুধু ইসলামাবাদের নয়, পুরো অঞ্চলের নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার দিকনির্দেশ হয়ে উঠছে। আর সেসব পদক্ষেপের পেছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে এক অদৃশ্য হাত—ওয়াশিংটন, তার আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা, এবং গাজা যুদ্ধ–পরবর্তী নতুন মধ্যপ্রাচ্য আঁকার মহাআকাঙ্খা।
আপনার মতামত জানানঃ