ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশের বাণিজ্যিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। শনিবার দুপুরে লাগা আগুন ২৭ ঘণ্টা চেষ্টা করার পর রোববার বিকেলে নিয়ন্ত্রণে আসে, কিন্তু ততক্ষণে পুড়ে গেছে বিপুল পরিমাণ আমদানি-রপ্তানি পণ্য। ব্যবসায়ীদের হিসেবে, এই আগুনে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, প্রকৃত ক্ষতি এর চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিকারকরা এবং ঔষধ শিল্পের উদ্যোক্তারা, যারা বলছেন, তাদের বহু বছরের বিনিয়োগ ও পরিশ্রম এক মুহূর্তেই ছাই হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ–এর শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, এই আগুন দেশের রপ্তানি খাতের জন্য বড় ধাক্কা। তাদের দাবি, কেবল প্রস্তুত পোশাক খাতেই ক্ষতির পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এমন ক্ষতির পর বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন, যা ভবিষ্যতের অর্ডার ও আস্থা—দুটোকেই বিপদে ফেলছে।
ওষুধ শিল্পের দিক থেকেও পরিস্থিতি ভয়াবহ। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি জানায়, আগুনে অন্তত ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়ে গেছে। এই সংখ্যা এখনো প্রাথমিক; সব তথ্য আসলে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বাড়তে পারে। এই কাঁচামালগুলোই দেশের ওষুধ উৎপাদনের মূল উপাদান, ফলে সামনের মাসগুলোতে বাজারে কিছু ওষুধের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটি শুধু আর্থিক নয়, জনস্বাস্থ্যের দিক থেকেও একটি বড় আঘাত।
এই ঘটনার পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন ক্ষতিপূরণ কে দেবে। পণ্য মালিকরা জানাচ্ছেন, তারা এখনো কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা পাননি। কারও পণ্য বিমা করা ছিল, কারও ছিল না। যাদের বিমা ছিল না, তারা এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তায়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র আমদানিকারক, এমনকি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সেবাগুলোও এই ক্ষতির শিকার। স্কাই বাই বিডি নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার রাসেল বিন আহাদ বলেন, তার ছয় টন মালামাল আগুনে পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, সব প্রক্রিয়া শেষ ছিল, কেবল ছাড় পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন—কিন্তু এর মধ্যেই সব পুড়ে শেষ হয়ে গেল। তার কণ্ঠে ছিল হতাশা, ক্ষোভ আর অসহায়ত্ব।
বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ নেতৃত্ব বলছে, সরকারকে এখনই ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য জরুরি তহবিল গঠন করতে হবে। এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “বিদেশি ক্রেতারা এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন। বাজারে আস্থা ফেরাতে হলে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “যাদের বিমা সুবিধা নেই, তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা তহবিল করা উচিত।”
এদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আগুনের ক্ষতি নিরূপণ ও ক্ষতিপূরণের সম্ভাব্য পথ নির্ধারণে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও আলাদা আরেকটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি হয়েছে। তবে এসব কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ পেতে সময় লাগবে। ফায়ার সার্ভিস এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি, আগুনের উৎস কোথায় ছিল—বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, অগ্নিসংযোগ নাকি অন্য কিছু।
কার্গো ভিলেজের যে অংশে আগুন লেগেছিল, সেটিই ছিল সবচেয়ে ব্যস্ত আমদানি ও রপ্তানি সংরক্ষণ কেন্দ্র। বিদেশ থেকে আসা পণ্য এখানে অস্থায়ীভাবে রাখা হতো এবং এখান থেকেই পোশাক, ইলেকট্রনিক পণ্য, ওষুধের কাঁচামাল, কৃষিপণ্য ও পার্সেল পাঠানো হতো। এমনকি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সংস্থাগুলোর অনেক কাজও এখানেই হতো। ফলে এই স্থাপনাটি পুড়ে যাওয়ায় বিমানবন্দর এখন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কর্তৃপক্ষ আপাতত বিমানবন্দরের ৯ নম্বর গেটে একটি অস্থায়ী শেড তৈরি করেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। এখনকার মতো যে পণ্যগুলো আসছে, সেগুলো খোলা জায়গায় রাখা হচ্ছে, যা বর্ষার সময় মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। বৃষ্টি বা আর্দ্রতা এলে অনেক পণ্য আবার নষ্ট হবে। সিএন্ডএফ এজেন্টরা বলছেন, “এখন যে ব্যবস্থাটা করা হয়েছে, তা সাময়িক। পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো কিছুই নেই।”
আগুনের পরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়, এখন থেকে পণ্য বন্দরে আসার দিনই খালাসের ব্যবস্থা করা হবে, যাতে জমে থাকা পণ্যের ঝুঁকি না বাড়ে। কিন্তু বাস্তবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা কঠিন। কারণ এত বড় ক্ষতির পর এখন নতুন পণ্য রাখার জায়গা, নিরাপত্তা, এবং হিসাব–সবই এলোমেলো।
এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন কাস্টমস অফিসে ভিড় করছেন, তারা জানতে চাইছেন, কীভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন। কিন্তু এখনো কোনো স্পষ্ট নীতি নেই। কেউ বলছেন, বিজিএমইএ সদস্যদের নথি জমা দিতে বলা হয়েছে; আবার যেসব আমদানিকারক সংগঠিত নন, তাদের কী হবে তা কেউ জানেন না। এক সিএন্ডএফ এজেন্ট বলছিলেন, “আমরা কাস্টমসের সাথে লেগে আছি, দেখা যাক কী হয়।”
অন্যদিকে অনেক ছোট ব্যবসায়ী মনে করছেন, এই অগ্নিকাণ্ডে তাদের ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে। কেউ বলেছেন, তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পণ্য এনেছিলেন; এখন পণ্য নেই, কিন্তু ঋণের চাপ রয়ে গেছে। ক্ষতিপূরণ না পেলে তারা দেউলিয়া হয়ে যাবেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই আগুনের প্রভাব কেবল কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বরং গোটা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ধাক্কা দিতে পারে। তৈরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত হাজারো শ্রমিকের কাজ, বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা, এমনকি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ—সবই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইএবি সভাপতি হাতেম বলেন, “যেসব কাঁচামাল পুড়েছে, সেগুলো দিয়েই পরের মাসের রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। এখন সেই পণ্য তৈরি করা সম্ভব নয়। অনেক আন্তর্জাতিক অর্ডার বাতিল হতে পারে।”
শিল্প বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, রপ্তানির গতি কমে গেলে দেশীয় কারখানাগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। যেসব কোম্পানি ইতোমধ্যে বিদেশি অর্ডার নিয়েছে, তাদের সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা কঠিন হবে। এতে ক্রেতারা ভবিষ্যতে অন্য দেশকে বেছে নিতে পারেন, যেমন ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়া। এভাবে বাজার হারানোর আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
এছাড়া এই অগ্নিকাণ্ডে সরকারি সংস্থাগুলোর প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অগ্নি–নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন এত দুর্বল ছিল। কেউ কেউ দাবি করছেন, প্রাথমিকভাবে আগুন ছোট ছিল, কিন্তু পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া না থাকায় তা ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হয়েছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে মূলত দাহ্য পণ্যের আধিক্য এবং ঘন ধোঁয়ার কারণে।
তদন্ত শেষ না হলেও সাধারণ মানুষ এখনই প্রশ্ন তুলছে, এই ধরণের অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি কেন ঘটে। কিছুদিন আগেও রাজধানীতে কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ও ব্যবসায়িক ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন হয়, রিপোর্ট আসে, তারপর সব কিছু আবার আগের মতো চলে। এবারও অনেকের আশঙ্কা, এই অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ ও দায়–দায়িত্বের প্রশ্ন সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাবে।
এখন যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল হয়নি। কার্গো ভিলেজের ভেতরে এখনো ধোঁয়ার গন্ধ, পোড়া প্লাস্টিক ও ধাতব কাঠামোর স্তূপ পড়ে আছে। অনেক মালিক জানেনই না তাদের পণ্য কোথায়, নষ্ট হয়েছে নাকি উদ্ধারযোগ্য। অনেকে কাগজপত্র হারিয়ে ফেলেছেন, কেউ বা দুর্ঘটনার পর থেকে যোগাযোগ পাচ্ছেন না তাদের সিএন্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরের এই অগ্নিকাণ্ড কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থার একটি গভীর দুর্বলতা উন্মোচন করেছে। এটি দেখিয়েছে যে এত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এখনো কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ক্ষতিপূরণ কে দেবে, কতটা দেবে—এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা, কিন্তু এই ঘটনার প্রভাব দেশের অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও মানুষের জীবনে দীর্ঘ সময় ধরে থেকে যাবে।
এই ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপত্তা ও দায়বদ্ধতাও কতটা জরুরি। কারণ এক মুহূর্তের অগ্নিকাণ্ড, এক অজানা ত্রুটি—তাতে পুড়ে যেতে পারে কেবল মালামাল নয়, এক দেশের রপ্তানি স্বপ্নও।
আপনার মতামত জানানঃ