ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে তিনজন বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাটি দুই দেশের সীমান্ত অঞ্চলে গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বুধবার রাতে ত্রিপুরার খোয়াই জেলার বিদ্যাবিল এলাকায় পাহাড়ি আদিবাসীরা গরু চোর সন্দেহে তিন বাংলাদেশিকে কুপিয়ে ও তির মেরে হত্যা করে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়। নিহত তিনজনই ছিলেন হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার সাধারণ দিনমজুর। তাদের পরিবার বলছে, তারা চোর ছিলেন না; বিড়ি পাতার জন্য সীমান্ত এলাকায় গিয়েছিলেন। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং দ্রুততম সময়ে নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার সকালে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এই হত্যাযজ্ঞ মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চরম লঙ্ঘন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এই ঘটনাকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে এবং ভারত সরকারের কাছে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত পরিচালনার আহ্বান জানাচ্ছে। পাশাপাশি এমন নৃশংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছে ঢাকা। মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, সীমান্তের যে প্রান্তেই মানুষ থাকুক না কেন, জাতীয়তা নির্বিশেষে সবার মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
এই হত্যাকাণ্ডের খবর প্রথমে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে। ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদের খোয়াই জেলা প্রতিনিধি আশীষ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, বুধবার সকালে বিদ্যাবিল এলাকায় স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটি দল তিনজন বাংলাদেশিকে গরু চোর সন্দেহে ধরে ফেলে। এরপর তাদের নির্মমভাবে কুপিয়ে ও তির মেরে হত্যা করা হয়। পরে স্থানীয় পুলিশ লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার খোয়াই হাসপাতালে তিনজনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শুরু করে এবং নিহতদের জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করে। নিহতরা হলেন হবিগঞ্জের আলীনগর গ্রামের আশ্বব আলীর ছেলে জুয়েল মিয়া (৩২), বাসুল্লা গ্রামের কনা মিয়ার ছেলে পণ্ডিত মিয়া (৪৫) এবং কবিলাশপুর গ্রামের কদ্দুস মিয়ার ছেলে সজল মিয়া (২০)। তাদের সবার পরিবারই স্থানীয়ভাবে চুনারুঘাটে বসবাস করে এবং তারা পেশায় দিনমজুর ছিলেন।
পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, তারা গরু চুরি করতে যাননি। নিহত পণ্ডিত মিয়ার স্ত্রী রোজিনা আখতার বলেন, “আমার স্বামী মঙ্গলবার সকালে কাজের কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। এরপর আর ফেরেননি। বৃহস্পতিবার পুলিশ যোগাযোগ করে জানায়, আমার স্বামীকে ত্রিপুরায় হত্যা করা হয়েছে।” কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসা রোজিনা বলেন, “আমার স্বামী কখনও চুরি করেননি। তিনি খেটে খাওয়া মানুষ। পুলিশের কোনো অপরাধীর তালিকায়ও তার নাম নেই। যে অপবাদ দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
একই কথা বলেন জুয়েল মিয়ার বড় ভাই হাবিবুর রহমানও। তিনি বলেন, “আমার ভাই বিড়ি পাতার জন্য সীমান্তে গিয়েছিল। ভারতের দিককার লোকেরা ধরে নিয়ে যায়, এরপর হত্যা করে। আমরা এমন বর্বরতা কল্পনাও করতে পারিনি।” স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তারেকুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, নিহতরা সীমান্ত পার হয়ে বিড়ি পাতা সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ভারতীয়রা তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। তিনি আরও বলেন, “তিনজনই গরিব মানুষ। তারা প্রতিদিনের খাবারের জন্য দিনমজুরের কাজ করতেন। চোর নয়, তারা শ্রমিক।”
এই ঘটনার পর বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে আলোচনা হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হবিগঞ্জের বাল্লার সীমান্তে বিএসএফ নিহতদের লাশ বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে। এরপর লাশ তিন পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাশ বাড়িতে পৌঁছানোর পর চুনারুঘাটে শোকের ছায়া নেমে আসে। গ্রামের মানুষ বলছে, এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড মানবতার সব সীমা অতিক্রম করেছে।
এই ঘটনায় সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন, যদি কেউ সত্যিই চুরি করতে যেত, তাহলে তাদের গ্রেপ্তার করে আইন অনুযায়ী বিচার করা যেত। কিন্তু কাউকে কুপিয়ে ও তির মেরে হত্যা করা কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। মানবাধিকারকর্মীরাও একই সুরে বলছেন, সীমান্তে এভাবে মানুষ হত্যা করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন।
বাংলাদেশ সরকারও বলেছে, এই হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র সীমান্তের নিরাপত্তা বিষয় নয়, এটি একটি মানবিক সংকটও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “জাতীয়তা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জীবনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সীমান্তের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, কেউ যেন এমন নিষ্ঠুরতার শিকার না হয়।”
ত্রিপুরা পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে। তারা বলছে, পাহাড়ি আদিবাসীরা গরু চোর সন্দেহে এই তিনজনকে হত্যা করেছে। তবে তদন্তে প্রকৃত সত্য কী বেরিয়ে আসে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, ভারত সরকার দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের শনাক্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
বাংলাদেশে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই বলছেন, গরু চোর সন্দেহে কাউকে হত্যা করার মানে হলো আইনকে অমান্য করা। অনেকে লিখেছেন, “মানুষের জীবন এত সস্তা হয়ে গেছে যে, সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যা করাও যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই বাংলাদেশিদের প্রাণহানির খবর আসে। কখনও বিএসএফের গুলিতে, কখনও স্থানীয় গ্রামবাসীর হামলায়। দীর্ঘদিন ধরে এসব ঘটনায় প্রতিবাদ হলেও কার্যকর প্রতিকার মেলেনি। প্রতি বছর ডজনখানেক বাংলাদেশি সীমান্তে প্রাণ হারায়। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় বিষয়টি প্রায়ই উঠে আসে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান দেখা যায় না।
এই ঘটনাটি আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে যে সীমান্ত অঞ্চলে মানুষের জীবন কতটা অনিরাপদ। যেসব মানুষ দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের অভাবে সীমান্তের কাছে যায়, তারা প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে জীবিকা খোঁজে। তাদের অপরাধ প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করা মানবতার পরিপন্থী।
চুনারুঘাটের গ্রামে এখন শোকের মাতম। নিহতদের পরিবার কাঁদতে কাঁদতে বলছে, তারা কেবল ন্যায়বিচার চায়। যেন আর কোনো পরিবারের এমনভাবে স্বজন হারাতে না হয়। নিহত পণ্ডিত মিয়ার ছোট ছেলে বলেছে, “আমি বাবার হত্যার বিচার চাই। যারা বাবাকে কুপিয়ে মেরেছে, তাদের যেন শাস্তি হয়।”
এই তিনজনের মৃত্যু কেবল তিনটি পরিবারের শোক নয়, এটি বাংলাদেশের সীমান্তবাসীর বেদনার প্রতীক। তারা প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকে—কখনও গুলি, কখনও হামলা। এবারও সেই ভয়াবহতার বাস্তব রূপ দেখা গেল ত্রিপুরায়।
বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, তারা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে চায়। ভারতের কর্তৃপক্ষও যদি দ্রুত ব্যবস্থা নেয়, তবে হয়তো এ ধরনের বর্বরতা কিছুটা হলেও থামানো সম্ভব হবে। না হলে সীমান্তের এই রক্তাক্ত বাস্তবতা চলতেই থাকবে।
ত্রিপুরার এই হত্যাকাণ্ড তাই কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি আমাদের মানবতার পরিমাপকও। সন্দেহ বা অভিযোগের ভিত্তিতে মানুষ হত্যা করা কখনও ন্যায্য নয়। ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে এমন মৃত্যু আরও ঘটবে, আরও পরিবার শোকে ভাসবে। এখনই প্রয়োজন সীমান্তে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আইন প্রয়োগের সঠিক বাস্তবায়ন। মানুষ যেন মানুষকে হত্যা না করে—এই মৌলিক বোধটুকু ফিরিয়ে আনাই আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আপনার মতামত জানানঃ