আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর আদালতে গতকাল রাষ্ট্রপক্ষ নতুন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে দাবি করেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় ২০০৬ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতে বলেন, তদন্ত ও প্রমাণে এমন তথ্য মিলেছে যা শুধু সাধারণ অপরাধ নয়—এগুলো ধারাভাষ্য করলে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে বিচার হওয়া উচিত।
প্রসিকিউটর জানান, রাজনৈতিক বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তারের পর তাদের গুম করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য জিম্মি রাখা হতো। কেউ কেউ পরবর্তীতে মামলা দিয়ে রাষ্ট্রে চালান করা হতেন, আবার কেউ প্রাইভেটভাবে গুম করে পরে খুন করে ফেলা হতো। একইসাথে তিনি জানালেন যে, টর্চার সেলে বন্দিদের ওপর অমানবিক কায়দায় নির্যাতন করা হতো। আলোচিত হওয়ার মতো ঘটনার মধ্যে রয়েছে বন্দিদের ঘূর্ণায়মান চেয়ারে শক্ত করে বেঁধে ইলেকট্রিক শর্ট দিয়ে দ্রুত ঘোরানো, কখনো বা মইয়ে বেঁধে এভাবে ঘোরানো হতো। এতে ভিক্টিমদের নড়ি-ভুড়ি উলটপালট হয়ে যেত এবং তাদের স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থা নষ্ট হয়ে যেত।
মিরপুরের এক ঘটনার উদাহরণ দিয়ে প্রসিকিউটর বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া কারো পরিবারের উদ্দেশ্য প্রথমে থাকত গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি যেন জীবিত আছে তা নিশ্চিত করা। সে ধরণের চেষ্টা চালাতে গেলে ঘুষের লেনদেনও হতো। তিনি আদালতে বর্ণনা করেন, একটি ঘটনায় বোনকে বাড়ি থেকে ডেকে বলা হয়েছিল এক লাখ টাকা তাড়াতাড়ি আনো, না হলে তাকে মেরে ফেলা হবে। বোন পুলিশকে ভরসা করে দ্রুত টাকা এনে দেয় ৫০ হাজার টাকা; এরপর পুলিশ বলে যে সময়মতো আসেনি, তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে — অর্থাৎ ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়। প্রসিকিউটর এরকম আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করেন যেখানে গ্রেপ্তারকৃতদের পরপর হত্যা করা হয়েছে, কেউ গুলি করে মারা হয়েছে এবং কারও মাথায় ঝাঁকড়া চুলে আগুন ধরে যাওয়ার মতো ужас-দৃশ্যও দেখা গেছে। তিনি বলেন, যারা এসব করেছে তারা কখনো হাসতেও দেখেছেন—মানুষকে মারার পর তাদের ওপর নির্দয় আচরণ করতেন।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গুলি করার আগে ভিক্টিমদের কাছে একটি প্রকারের কনভেনশনাল ওষুধ বা সিডিটিপ (সিডিটিপ) গ্রাস করানো হতো যাতে তারা অচেতন হয়ে যায় এবং প্রতিবাদ করতে না পারে। এরপর তাদের মাথায় ‘যম টুপি’ পরিয়ে গুলি করা হতো—এগুলো রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা সাক্ষ্য ও প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, গুমের পর অনেক ভিক্টিমকে ট্রলারে তুলে নদীর মাঝখানে বা সাগরের গভীরে নিয়ে যাওয়া হতো; সেখানে গুলি করে পেট কেটে লাশ লুকানোর চেষ্টাও করা হতো যাতে পরবর্তীতে মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া না যায়। এমনকি এক অফিসারের গাড়িতে দশ কেজি ওজনের হাতুড়ি রাখা হতো; যে ব্যক্তিকে মেরেছে তাকে ওই হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হতো—এগুলো তদন্তে পাওয়া একাধিক বিবরণে উঠে এসেছে বলে প্রসিকিউটর আদালতে জানান।
আইনি ভাষায় রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন করে তাজুল ইসলাম বলেছেন, কেউ যদি দাবি করেন যে তারা তাদের সুপিরিয়র অফিসারের আদেশ পালন করছিলেন, তাতে তারা দায় থেকে মুক্তি পাবে না। তিনি ব্যাখ্যা করেন, আন্তর্জাতিক আইন ও ট্রাইব্যুনাল-সংক্রান্ত বিধান অনুসারে ইন্ডিভিজুয়াল অপরাধের দায় ব্যক্তির ওপর বর্তায়; ‘আমি অর্ডার মেনে حرکت করেছি’—এই দাবি সাধারণত প্রতিরক্ষা হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেছেন, মিলিটারি অফিসারদের বিচার সম্পর্কে যে তর্ক দাঁড়ানো হয় যে তারা নিজেদের স্বপ্রতিষ্ঠিত আদালতে বিচার পাবে—তবে যদি কেউ মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ বা গণহত্যার মতো গুরুতর অপরাধ করে, তাহলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের অধীনে তাদের বিচারযোগ্যতা রয়েছে। প্রসিকিউটর উদাহরণ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত নির্যাতনের বিষয়ে সেই আইনি প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছেন, যদিও সেসব মামলায় রায় নাও হতে পারে।
আদালতের বেঞ্চও বক্তব্যে বলেছে যে, বিচারকদেরও জবাবদিহিতা থাকা প্রয়োজন। তারা উল্লেখ করেছে, কিছু সময় প্রশাসনিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও বিচারকদের নির্দিষ্টভাবে কোন ধরনের দোষে অভিযুক্ত করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, বিচার কার্যবিধির নামে যেকোনো স্বাধীনতা মানে নেই যে একজন বিচারক ইচ্ছেমত আচরণ করবেন; তাদেরও একটি সুসংগঠিত সিস্টেমে থাকতে হবে। বিচারকরা বলেন যে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলা পেন্ডিং রয়েছে এবং সেগুলো দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে নিষ্পত্তি করতে নজর দিতে হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পরে ট্রাইব্যুনাল-এ নির্দেশ হয়েছে, পরের ধাপে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করবেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ তাদের জবাব দেবে। আদালত শেষে সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য মামলাটি অপেক্ষমান রাখবে। প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপনকৃত প্রমাণ ও দলিলগুলো বিচারিক পর্যায়ে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে। ট্রাইব্যুনাল আজ সোমবার রাষ্ট্রপক্ষের পরবর্তী যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করেছেন।
কিছু মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বর্ণনা অনুযায়ী যে আচরণ ও পদ্ধতি দেখানো হয়, সেগুলো মানবধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে কিনা—সেটি নির্ণয়ের দায়িত্ব আদালতের। প্রসিকিউটরের বর্ণিত সব ঘটনাই অভিযোগের পর্যায়ে আছে; আসামিপক্ষের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা ও প্রমাণ উপস্থাপিত হলে বিচারকরা নিরপেক্ষভাবে তা যাচাই করবেন। আদালতীয় প্রক্রিয়া অনুযায়ী প্রত্যেক অভিযুক্তকে নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হবে এবং নির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনে সাজা বা মুক্তি নির্ধারিত হবে।
এসময়ে মানবাধিকার সংগঠন, স্বাধীন আইনজীবী বা অন্য কোন দল যদি এই বিষয়গুলোতে বিবৃতি দেয় বা আলাদা মত প্রকাশ করে—সেগুলোও বিচার পর্যায়ে বিবেচ্য হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত আদালতে যা উপস্থাপন করা হয়েছে তা রাষ্ট্রপক্ষের দাবি ও যুক্তিতর্ক; সেগুলোর সত্যতা এবং দায়দ্বিত্ব আদালতের রায়ে স্পষ্ট হবে। মামলার প্রক্রিয়া চলমান থাকায় প্রত্যেক পর্যায়েই সাক্ষ্য, দলিল ও যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে—এটাই বিচারব্যবস্থার মূল কায়দা।
নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক এবং সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিতে এমন অভিযোগগুলো গুরুতর ও উদ্বেগজনক; যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তা দেশের ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার কাঠামোর জন্য বড় ধরনের ইস্যু হয়ে উঠবে। একইসঙ্গে অভিযোগপ্রাপ্ত যারা—তাদেরও আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নির্দিষ্টভাবে ওষুধপ্রমাণ, সাক্ষ্য ও পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করার অধিকার রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-এর কাজ হবে সব প্রমাণাদি বিবেচনা করে আইন অনুযায়ী স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত রায় দেওয়া।
ট্রাইব্যুনাল-১-এর কক্ষে গতকাল মতামতপোষণ ও যুক্তিতর্ক-প্রস্তাবের সেই পর্যায়ে এসে বিষয়গুলো আবার সক্রিয়ভাবে আলোচিত হলো। এখন অপেক্ষা আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক-উপস্থাপনা ও রাষ্ট্রপক্ষের জবাব—এর পরই বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এগোবে। আদালত এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষদের দ্বারা উপস্থাপিত সব তথ্যই ভবিষ্যৎ রায় নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রাখবে।
আপনার মতামত জানানঃ