মহামারীকালে পরীক্ষা ছাড়াই আগের পরীক্ষার ভিত্তিতে এবারের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় সবাইকে পাস করানো হয়েছে, জিপিএ-৫ পেয়েছে দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। পরীক্ষা না নিয়ে ফল প্রকাশে আইন সংশোধনের পর শনিবার একযোগে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়, যাতে পৌনে ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর অপেক্ষার অবসান ঘটল।
পরীক্ষা ছাড়াই প্রকাশ করা এইচএসসির ফলাফলে রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এবার ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন, যা ২০১৯ সালের তুলনায় তিনগুণ বেশি। ওই বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল মাত্র ৪৭ হাজার ২৮৬ জন এবং তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে ২৯ হাজার ২৬২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। শতকরা হিসেবে ২০২০ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছেন মোট পরীক্ষার্থীর ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে যা ছিল মোট পরীক্ষার্থীর ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এছাড়া, ২০১৯ সালে মোট পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ছিল ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
এর আগে, ১৯৭১ সালে পরীক্ষা ছাড়া সব শিক্ষার্থীকে পাস করানো হয়েছিল। এবার করোনাকালে সেই একই পথে হাঁটল সরকার।
৩০জানুয়ারি ২০২১, শনিবার সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এ ফলাফল ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে অনলাইনে ফলাফল ঘোষণা অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং সব বোর্ডের চেয়ারম্যানরা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে পরীক্ষা ছাড়া অটোপাস পদ্ধতি নিয়ে অনেকরকম কথা বলার চেষ্টা করছেন। শিক্ষার্থীদের জীবনের কথা ভেবেই এই পদ্ধতিতে ফল দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তিক্ত বা বিরূপ মন্তব্য করা থেকে সমালোচনাকারীদের বিরত থাকতে অনুরোধ করেন তিনি।
করোনাভাইসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার আগে এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেলেও আটকে যায় এইচএসসি পরীক্ষা।মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ায় গত ৭ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনীর মতো এইচএসসি পরীক্ষাও নেওয়া যাচ্ছে না।
এরপর অষ্টমের সমাপনী এবং এসএসসির ফলাফলের গড় করে ২০২০ সালের এইচএসসির ফল নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। জেএসসি-জেডিসির ফলাফলকে ২৫ এবং এসএসসির ফলকে ৭৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষিত হল। কিন্তু আইনে পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশের বিধান থাকায় তা সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বিশেষ পরিস্থিতিতে পরীক্ষা ছাড়াই ফল প্রকাশের বিধান যুক্ত করে গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদে আইন সংশোধন করতে হয়। এরপর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রস্তুত, ঘোষণা ও সনদ বিতরণের জন্য শিক্ষা বোর্ডগুলোকে ক্ষমতা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রতি বছর এইচএসসির ফল ঘোষণার পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বাঁধ ভাঙা উল্লাস থাকলেও এবার তার ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। ফল ঘোষণার পর রাজধানীর হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, মতিঝিল আইডিয়ালসহ সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা শূন্য।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এইচএসসি ও সমমানের ফল জানার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিড় না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এছাড়া ঘরে বসেই শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এসএমএস পাঠিয়ে মূল্যায়নের ফল জানতে পেরেছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রোহামা রুয়েত অধরা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ বছর অন্যান্যদের মতো আমাদের তেমন আনন্দ উল্লাস নেই। পরীক্ষা ছাড়া আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। আমি মনে করছি না আমার মেধাকে যথাযত মূল্যায়ন করা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের প্রায় ১৪ লাখ এইচএসসি ও সমমান উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ভালো ফল পেয়েও এবার মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারার শঙ্কা রয়েছে এই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। কারণ এ বছর পাস ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি উভয় ক্ষেত্রেই রেকর্ডের সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ (২০১৯) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে স্নাতক পাস/স্নাতক সম্মান ও সমমান পর্যায়ে ভর্তিযোগ্য মোট আসন রয়েছে মাত্র ৪৭ হাজার ১৭১টি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তিযোগ্য আসন রয়েছে ৮ লাখ ৭২ হাজার ৮১৫টি। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন রয়েছে ৬ হাজার ৭৫টি। সব মিলিয়ে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন রয়েছে মাত্র ৯ লাখ ২৬ হাজার ৬১টি। এ ছাড়া ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পাস/ স্নাতক সম্মান ও সমমান পর্যায়ে ভর্তিযোগ্য মোট আসন রয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ১৫৭টি। সব মিলিয়ে সারা দেশে ১১ লাখ ১১ হাজার ২১৮ জন শিক্ষার্থীর ভর্তিযোগ্য আসন রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে গতকাল ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সাংবাদিকদের বলেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গত বছর যে সুযোগ ছিল, এবার স্বাভাবিকভাবে একটু বেড়েছে। সবাইকেই এ পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে, বিভিন্নভাবে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে নিজেদের মেধার পরিচয় দিয়েই ভর্তির সুযোগ পাবে তারা। মন্ত্রী বলেন, পাস করা সব শিক্ষার্থী ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ না পেলেও ভর্তির সুযোগ রয়েছে।
শিক্ষাসংম্লিষ্টদের অভিমত, স্বল্প আকারেও হলেও শিক্ষাবোর্ডগুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়ন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। পরীক্ষাবিহীন গণমূল্যায়নের কারনে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি হতাশা চলে আসতে পারে। এছাড়া ‘অটোপাশ’ বুলিং এর শিকার হয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হওয়ার কারণে দেশে মেধার সঙ্কট তৈরি হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। সরকারের শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের সিদ্ধান্ত গ্রহনে দৈন্যতার কারণে শিক্ষাবিভাগে এই ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল।
এসডব্লিউ/এফএ/নসদ/১১১৫
আপনার মতামত জানানঃ