বাংলাদেশে টেলিভিশন লাইসেন্স দেওয়ার ইতিহাস সবসময়ই রাজনৈতিক বিতর্কে ভরা। এবার অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুটি নতুন টিভি চ্যানেলকে সম্প্রচারের অনুমতি দেওয়ায় আবারও সেই বিতর্ক ফিরে এসেছে। সরকার দাবি করছে তারা আইনি নিয়ম মেনেই অনুমোদন দিয়েছে, কিন্তু সমালোচকরা বলছেন আগের সরকারের মতো এবারও দলীয় ঘনিষ্ঠদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাকে ঘিরে গণমাধ্যম সংস্কার, রাজনৈতিক প্রভাব ও টেলিভিশন লাইসেন্স বাণিজ্যের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো আবারও সামনে এসেছে।
নতুন লাইসেন্স পাওয়া দুই ব্যক্তির একজন জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির নেতা, যিনি আগে একটি পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন। অন্যজনও এনসিপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, তিনি পূর্বে নাগরিক কমিটির সদস্য ছিলেন এবং সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। তারা দুজনেই জানিয়েছেন যে তারা আইন মেনে আবেদন করেছেন এবং তাদের উদ্যোগে বিনিয়োগকারী ও পেশাদার লোকজন যুক্ত আছেন। তথ্যমতে, তাদের কোম্পানির একটির নাম ‘৩৬ মিডিয়া লিমিটেড’ যা ‘নেক্সট টেলিভিশন’ নামে সম্প্রচার শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যটির নাম ‘লাইভ টিভি’। উভয় প্রতিষ্ঠানই সম্প্রতি লাইসেন্স, তরঙ্গ বরাদ্দ ও যন্ত্রপাতি আমদানির অনুমতি পেয়েছে।
তবে গণমাধ্যম পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তারা মনে করেন, আগের সরকারগুলো যেমন দলীয় বিবেচনায় ঘনিষ্ঠদের লাইসেন্স দিয়েছিল, বর্তমান সরকারও সেই ধারা থেকে বের হতে পারেনি। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সরকার গণঅভ্যুত্থানের চেতনা অনুযায়ী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারত, কিন্তু তা না করে আবারও আগের সংস্কৃতি বজায় রেখেছে। তার মতে, এটি সেই বার্তা দিচ্ছে যে সরকার কর্তৃত্ববাদের পতন চাইলেও সেই সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে চাইছে।
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম অবশ্য এই অভিযোগ নাকচ করেছেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। বরং আমরা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে চাই, যেখানে বিভিন্ন মতের গণমাধ্যম কাজ করতে পারে।” তার মতে, সরকার কোনো মিডিয়া বন্ধ করছে না, বরং নতুন মিডিয়া গড়ে তুলতে চায় যা পরিবর্তনের প্রতীক হবে।
বাংলাদেশে টেলিভিশন লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া বেশ জটিল। একজন আবেদনকারীকে প্রথমে একটি কোম্পানি গঠন করতে হয় এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র, আয়কর সার্টিফিকেট, ব্যাংক সলভেন্সি, ট্রেড লাইসেন্স ও প্রজেক্ট প্রস্তাবসহ তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হয়। এরপর মন্ত্রণালয় তা যাচাই করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠায়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তদন্ত শেষে রিপোর্ট ইতিবাচক হলে আবেদনকারীকে অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়। তারপর বিটিআরসি থেকে তরঙ্গ বরাদ্দ নিতে হয় এবং স্যাটেলাইট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হওয়া জরুরি, কিন্তু বাস্তবে সেটা সচরাচর হয় না।
বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন হিসেবে ১৯৯৮ সালে একুশে টেলিভিশন সম্প্রচারে আসে। তখন আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন চালুর অনুমতি দেয়। পরবর্তীতে বিএনপি সরকার আসার পর একুশে টিভির লাইসেন্স নিয়ে আইনি জটিলতা তৈরি হয় এবং সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে মালিকানা বদলে আবার সম্প্রচারে ফিরে আসে। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি সরকারই তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, রাজনীতিক বা সাংবাদিকদের লাইসেন্স দিয়েছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় সরকারের সময়েই দলীয় আনুগত্য ও স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে টিভি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
এই প্রক্রিয়ায় অনেকে লাইসেন্স নিয়ে তা পরে বিক্রি করেছেন, যা এক ধরনের বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, একাত্তর টিভির লাইসেন্সের একটি অংশ বিক্রি করা হয়েছিলো মেঘনা গ্রুপের কাছে, সময় টিভির লাইসেন্স বিক্রি হয়েছিলো সিটি গ্রুপের কাছে এবং চ্যানেল নাইনের ৮৫ শতাংশ মালিকানা বিক্রি হয়েছিলো কোটি টাকার বিনিময়ে। এতে দেখা যায় যে, টেলিভিশন লাইসেন্স অনেক সময় ব্যবসায়িক হাতবদলের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সাংবাদিকতার আদর্শ বা গণমাধ্যমের নীতির চেয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থ বড় ভূমিকা রাখছে।
বর্তমানে দেশে ৫৩টি বেসরকারি টেলিভিশন লাইসেন্স দেওয়া হলেও সক্রিয়ভাবে সম্প্রচারে আছে মাত্র ৩৬টি চ্যানেল। অনেক চ্যানেল আর্থিক সংকট বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা ও সাংবাদিকদের অবস্থানও বদলে যায়। আওয়ামী লীগ আমলে যেখানে আওয়ামীপন্থি সাংবাদিকরা প্রভাবশালী ছিলেন, এখন সেখানে বিএনপি বা জামায়াতপন্থি সাংবাদিকদের প্রভাব বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সমালোচকরা মনে করেন, গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার এই প্রবণতা বন্ধ না হলে দেশের সংবাদ পরিবেশ কখনোই স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ হবে না। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, তারা সরকারের কাছে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যাতে টেলিভিশন লাইসেন্স বিতরণ স্বচ্ছভাবে হয়। কিন্তু সরকার সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেনি।
অন্তর্বর্তী সরকার এখন দাবি করছে যে তারা পরিবর্তনের পথে, কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তে সেই পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট নয়। বরং আগের মতোই রাজনৈতিক প্রভাব, দলীয় আনুগত্য ও আর্থিক স্বার্থের ছাপ স্পষ্ট। টেলিভিশন লাইসেন্স বিতরণের এই প্রক্রিয়া আবারও প্রমাণ করছে যে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখনো রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
যদিও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, তারা আইনের মাধ্যমে নতুন নীতিমালা করতে চান, কিন্তু সময় বলে দেবে এই সরকারের হাতে সত্যিই গণমাধ্যম সংস্কারের নতুন অধ্যায় শুরু হয় কি না। আপাতত এই সিদ্ধান্ত গণমাধ্যম জগতে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং জনগণের মনে আবারও সেই পুরনো প্রশ্ন জাগিয়েছে— বাংলাদেশে আসলেই কি স্বাধীন গণমাধ্যমের যুগ আসছে, নাকি শুধু মালিক আর রাজনৈতিক দল বদলাচ্ছে, বাকিটা একই থেকে যাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ