বাংলা ও বাঙালি জাতিকে বলা হয় আন্দোলনপ্রিয় জাতি। ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায়, আন্দোলনের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদের ভাগ্য গড়ার চেষ্টা করেছে বারবার। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা এসেছে, ভাষা রক্ষা হয়েছে, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম হয়েছে। তবে এ আন্দোলনের ধারা কেবলই রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা অধিকার আদায়ের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সমাজব্যবস্থা, এমনকি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছে। ব্রিটিশ ভারতে আন্দোলনের চাপেই রাজধানী কলকাতা থেকে নয়াদিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। কলকাতা ছিল তখনকার সমৃদ্ধ বাংলার প্রাণকেন্দ্র। রাজধানী হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার অর্থনৈতিক পতনের সূচনা হয়, যা এক সময়ের অন্যতম ধনী অঞ্চলকে ঘাটতির জায়গায় পরিণত করে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাংলার মানুষ আরও এক বিভাজনের শিকার হয়। পূর্ববঙ্গ হয় পূর্ব পাকিস্তান, আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবুও আন্দোলনের ধারা থেমে যায়নি। বাঙালি রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া। সেই প্রতিবাদ হয়তো ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ইস্যুতে হয়েছে, তবে জনসমাগম, স্লোগান আর মিছিলের মাধ্যমে মানুষের অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং আন্দোলনের ধারা বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক লিফলেট, স্লোগান, এমনকি আন্দোলনের কৌশল বাংলাদেশেও এসে পৌঁছেছে। অনেক সময় সেখানে ব্যবহৃত ভাষাকে সামান্য বদল করে হুবহু প্রচার করা হয়েছে এখানে। সত্তরের দশক পর্যন্ত এই প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা গেছে, যদিও পরে তা কমে গেছে।
আন্দোলনের সঙ্গে পুলিশের সংঘাতও এই ভূখণ্ডে এক অনিবার্য বাস্তবতা। আন্দোলন মানেই যেন রাস্তা আটকে মিছিল, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ। পুলিশের দায়িত্ব শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা হলেও, তাদের কাজ প্রায়ই দমন-পীড়নের সমার্থক হয়ে উঠেছে। কলকাতার আন্দোলনকারীরা একসময় একটি স্লোগান তৈরি করেছিল—“পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার এক শ বারো।” এই স্লোগান শুধু কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সীমানা পেরিয়ে চলে এসেছে ঢাকাতেও। কয়েক বছর আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্রছাত্রীদের মুখেও এই স্লোগান শোনা গেছে। এর অন্তর্নিহিত বার্তা ছিল স্পষ্ট—পুলিশের লাঠিচার্জ, মারধর, দমননীতি কোনো কিছুর মাধ্যমে মানুষের প্রতিবাদ থামানো যাবে না। পুলিশ যতই মারুক, তাদের অবস্থা অপরিবর্তিত থাকবে, কারণ তারা সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হয়ে কাজ করছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্দোলন দমনের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, ভিন্নমত বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। যে পুলিশ একসময় সাদেক হোসেন খোকাকে রক্তাক্ত করেছে, সেই একই পুলিশ মতিয়া চৌধুরীকেও রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছে। সরকার যেই হোক না কেন, পুলিশকে তারা নিজেদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবেই ব্যবহার করেছে। ফলে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে পুলিশবাহিনী মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সমাজে এমন ধারণা গড়ে উঠেছে যে, পুলিশের খপ্পরে পড়া মানেই আজীবন ভোগান্তি। একটি প্রবাদ আছে—“বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা।” এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে—“পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।” অর্থাৎ পুলিশের সঙ্গে একবার জড়িয়ে পড়া মানেই অনন্ত দুর্ভোগ। মামলা করলে বছরের পর বছর আদালতে হাজিরা দিতে হয়, উকিলের পেছনে সর্বস্বান্ত হতে হয়, অথচ ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যায়। এ কারণে সাধারণ মানুষ পারতপক্ষে থানায় যায় না, মামলা করে না। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক মানেই ভোগান্তি—এমন ধারণা বহুদিনের এবং তা কোনো এক দিনে তৈরি হয়নি।
এই চিত্র স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসার পর প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করেছে। কখনো দলীয় লাঠিয়ালরা পুলিশের ছায়ায় থেকে হামলা চালিয়েছে, কখনো আবার পুলিশই সরাসরি হামলাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। চব্বিশের জুলাইয়ের আন্দোলনের সময়ও এই দৃশ্য দেখা গেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়, বরং এটি দীর্ঘ দিনের একটি কাঠামোগত সংকট। প্রশ্ন হচ্ছে, এর দায় পুলিশের ওপর কতটুকু? বাস্তবতা হলো, পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করে এসেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। পুলিশ বাহিনী হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রভাবের বলি।
তবে পুলিশের কাজ কেবল দমন-পীড়ন হওয়া উচিত নয়। প্রকৃতপক্ষে পুলিশের প্রধান দায়িত্ব হলো অপরাধী শনাক্ত করা, অপরাধের তদন্ত করা এবং আদালতের কাছে অপরাধীকে সোপর্দ করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কনস্টেবলসহ বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে এ ধরনের কাজে সম্পৃক্ত করা হয় না। বরং তাদের ব্যবহার করা হয় ‘ফোর্স’ হিসেবে—আন্দোলন দমনে, বিরোধীদল দমন করতে। ফলে তদন্তে মেধাবী জনশক্তি অপচয় হচ্ছে, অপরাধ দমনের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে পুলিশ বাহিনীতে পেশাদারিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে, দলীয়করণ জেঁকে বসছে। পাকিস্তান আমলে পুলিশে সীমিত নিয়োগ থাকলেও স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাপক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে মেধার স্বীকৃতি কমে গেছে, প্রমোশন ও পদোন্নতিতেও দলীয়করণ স্থান পেয়েছে।
এ অবস্থার পরিবর্তনে বহুদিন ধরেই নাগরিক সমাজের দাবি, একটি স্বায়ত্তশাসিত পুলিশ কমিশন গঠন করা হোক, যাতে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে পুলিশ মুক্ত হয়ে পেশাদারিত্ব অর্জন করতে পারে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকেও এই বিষয়টি জোর দিয়ে বলা হয়। বর্তমান আইজিপিও জানিয়েছেন, জনমুখী পুলিশ চাইলে কিছুটা স্বাধীনতা দিতে হবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেন মামলা-গ্রেপ্তার বা চার্জশিটের ওপর প্রভাব না ফেলতে পারে। এতে পুলিশের প্রকৃত কার্যক্ষমতা বাড়বে। আসলে পুলিশকে কাজ করতে দেওয়া হলে তারা তা করতে সক্ষম—এমন নজিরও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে। যেমন শীর্ষ সন্ত্রাসী মনিরসহ কয়েকজন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয় গণমাধ্যমের উদ্যোগে বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর।
কিন্তু সমস্যা এখানেই যে, পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলে তারা পেশাদার হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু রাজনীতিবিদেরা কখনোই সেই প্রভাব ছাড়তে রাজি নন। আদালত ও বিচারব্যবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, স্বাধীনতা দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। প্রয়োজন সৎ, মেধাবী ও সাহসী কর্মকর্তা, যারা নীতি মেনে কাজ করতে পারবেন। সেই সঙ্গে দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য—পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার না করার দৃঢ় অঙ্গীকার।
বাংলার ইতিহাস প্রমাণ করে, আন্দোলনপ্রিয় এই জাতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পিছপা হয় না। কিন্তু পুলিশ যদি সেই আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হয়, তবে জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক ক্রমেই দূরত্ব বাড়াবে। পুলিশ যদি সত্যিকার অর্থে অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত হয়, তবে তাদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে। প্রশ্ন এখন কেবল একটি—আমরা কি পুলিশের সেই রূপ দেখতে চাই, নাকি রাজনৈতিক প্রভাবের লাঠিয়াল পুলিশকে আঁকড়ে ধরে এগোতে চাই? বাঙালির ইতিহাস বলে, আন্দোলন চলবেই, স্লোগান উঠবেই, ভিন্নমত প্রকাশ হবেই। এখন প্রয়োজন পুলিশকে জনগণের বন্ধুতে পরিণত করা, শাসকের হাতিয়ার নয়।
আপনার মতামত জানানঃ