বাংলাদেশে বিরল রোগ এখনো চিকিৎসা ব্যবস্থার এক অনালোচিত ও অবহেলিত অধ্যায়। বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুদের গল্প শোনার পর যে চিত্রটি সামনে আসে, তা শুধু চিকিৎসা-সংকটের নয়; বরং এটি আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এসএমএ, ডিএমডি, হিমোফিলিয়া, প্রজেরিয়া, এক্সপি কিংবা ট্রি ম্যান সিনড্রোমের মতো রোগগুলো হয়তো নামেই পরিচিত, কিন্তু আক্রান্ত পরিবারের জীবনে এরা দুর্বিসহ দৈনন্দিনতা তৈরি করে।
চার বছরের শিশু অলিভিয়া সঞ্চারী নবনী দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারে না। বাবার কোলে বসে গান গায়, হাসে, গল্প করে, কিন্তু সোজা হয়ে বসতে গেলেই মাথা ঢলে পড়ে যায়। চিকিৎসকেরা জানালেন, নবনী স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ) নামক বিরল রোগে আক্রান্ত। জন্মের কিছুদিন পরেই তার পায়ের নড়াচড়া কমতে শুরু করে। বাবা-মা দেশীয় বিশেষজ্ঞদের কাছে ছুটে গেছেন, অবশেষে ভারতের চেন্নাই গিয়ে রোগ ধরা পড়ে। এসএমএ জিনগত ত্রুটির কারণে হয় এবং এটি ধীরে ধীরে শিশুর শরীরের পেশি দুর্বল করে ফেলে।
এমনই আরও অনেক গল্প আছে। খুলনার নূরজাহান রজনী ও মেহেদি হাসান আমিরের মেয়ে আমিরা হেঁটে বা বসতে পারে না। সে বাবা-মাকে বলে, “রাগ কোরো না, আমি পারি না।” এই কথাগুলো শুনে মায়ের বুক ফেটে যায়। অন্যদিকে ব্যবসায়ী ওমর ফারুকের দুই সন্তানই বিরল রোগে আক্রান্ত। তিনি জানান, তাদের জীবনে আনন্দ নামের শব্দটি আর নেই। রাজধানীর এক অভিভাবক তো বললেন, তাদের তিন সন্তানেরই একই বিরল রোগ ধরা পড়ে; এর মধ্যে একজন মারা গেছে, বাকিদের নিয়ে ঘরের খাটে রাত কাটান তারা।
বিরল রোগের চিকিৎসা যে কত ব্যয়বহুল হতে পারে, এসএমএ তার উদাহরণ। এই রোগের তিনটি চিকিৎসা পদ্ধতি আছে—জিনথেরাপি, মেরুদণ্ডে ইনজেকশন, আর সিরাপ। জিনথেরাপি একবারই দিতে হয়, কিন্তু খরচ ২২ কোটি টাকা। ইনজেকশনের প্রতিটি ডোজের দাম এক কোটি টাকা। সিরাপের প্রতিটি বোতলের দাম ১০ লাখ টাকা, মাসে এক বোতল লাগে। বাংলাদেশে মাত্র কয়েকজন শিশু বিনামূল্যে এই ওষুধ পাচ্ছে। নবনীও তাদের একজন। বাকিদের ভাগ্যে এ সুযোগ আসে না।
ডিএমডি নামের আরেকটি বিরল রোগ মূলত ছেলেদের হয়। শিশুর বয়স ১০–১২ হতে না হতেই সে পা বাঁকিয়ে ফেলে, আর নিজে থেকে হাঁটতে অক্ষম হয়ে পড়ে। মোহাম্মদ পারভেজের ছেলে মুনতাসির এখন হুইলচেয়ারে। বাবা অসহায় কণ্ঠে বললেন, “চোখের সামনে ছেলেটা অচল হয়ে গেল, অথচ আমি কিছুই করতে পারলাম না।”
এসব রোগ শুধু শারীরিক যন্ত্রণাই দেয় না, মানসিক আঘাতও দেয় গভীরভাবে। মা-বাবা সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সাংস্কৃতিক সংগঠনে সক্রিয় এক দম্পতি এখন কেবল সন্তানের চারপাশেই সীমাবদ্ধ। ঘরেই তাদের পৃথিবী আটকে গেছে। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা, অনুষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তিগত সময়—সবই হারিয়ে গেছে।
চিকিৎসা পদ্ধতির আরেকটি বড় সমস্যা হলো রোগ শনাক্তে দেরি। অনেক বাবা-মা একাধিক হাসপাতালে ঘুরে সঠিক রোগ নির্ণয় পাননি। শিশুটি দিনে দিনে দুর্বল হয়েছে, অথচ চিকিৎসকেরা ভুল চিকিৎসা দিয়ে গেছেন। এমনকি শিক্ষিত, সচেতন মানুষও একই অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। আফরিন আক্তার নামের এক তরুণী প্রথমে ভুল চিকিৎসার শিকার হন, পরে দেশে ও বিদেশে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন তিনি এসএমএ রোগী।
বাংলাদেশে এখনো বিরল রোগ নিয়ে কোনো কেন্দ্রীভূত নীতি নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বীকার করেছেন, তাদের কোনো পৃথক শাখা নেই, সামগ্রিকভাবেও কাজ হয় না। কেবল কোনো রোগ নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলেই অস্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষ ক্লিনিক চালাচ্ছে এবং নিয়মিত সেমিনার করছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেবল এসএমএ রোগীদের জন্য ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে, তবে অন্যান্য বিরল রোগের জন্য কোনো পরিকল্পনা নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বে প্রায় ৭ হাজার বিরল রোগ আছে, ৩০ কোটি মানুষ এতে আক্রান্ত। তবে ৯৫ শতাংশ রোগের কার্যকর চিকিৎসা নেই। গবেষণায় বিনিয়োগ কম হওয়ায় নতুন ওষুধ আসছে না, আর যা আসছে তার দাম আকাশচুম্বী। ফলে অভিভাবকেরা জানেন, সন্তানের চিকিৎসা হয়তো হবে না, অথবা চিকিৎসা করালেও তাকে বাঁচানো যাবে না। এই অসহায় অনুভূতি অনেককে ভেঙে ফেলে।
তবে আশার আলোও আছে। বাংলাদেশে কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠেছে, যারা বিরল রোগে আক্রান্ত শিশু ও পরিবারকে সাহায্য করছে। কিওর এসএমএ বাংলাদেশ, ডিএমডি কেয়ার ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তারা সচেতনতা বাড়াচ্ছে, ওষুধের দাম কমানোর জন্য চেষ্টা করছে এবং বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল তৈরি করা জরুরি। জেনেটিক ল্যাব স্থাপন করতে হবে, যাতে দ্রুত রোগ শনাক্ত করা যায়। একইসঙ্গে একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, যাতে রোগীরা ভুল প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সময় ও অর্থ নষ্ট না করেন।
সবশেষে বলা যায়, বিরল রোগ আসলে শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক সমস্যা। আক্রান্ত পরিবারগুলো একদিকে আর্থিক সংকটে জর্জরিত হয়, অন্যদিকে মানসিক ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের সন্তানদের চিকিৎসা বা জীবনের মান উন্নয়ন শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি একটি মানবিক দায়িত্ব।
বাংলাদেশে এখনো বিরল রোগ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতি প্রণয়ন হয়নি। অথচ শিশুদের জীবন রক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ রাখার জন্য এটি এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্রকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে, পাশাপাশি সমাজকেও সংবেদনশীল হতে হবে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের জন্য প্রতিটি দিনের লড়াই বেঁচে থাকার লড়াই। আর এই লড়াইয়ে যদি তারা একা থাকে, তবে আমাদের মানবিকতার পরাজয় হবে।
আপনার মতামত জানানঃ