বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে ঘিরে দিল্লির রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী মহলে এখন এক ধরনের দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। পাঁচ মাস পরেই নির্বাচন হওয়ার কথা, অথচ দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা পেয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে যাদের ওপর নির্ভর করেছিল দিল্লি, তারা অন্তত এই নির্বাচনে মাঠে নামতে পারবে না। এর ফলে ভারত কীভাবে নিজের কৌশল সাজাবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কারণ, একদিকে ভারতের ঘোষিত অবস্থান হলো বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখতে চায়; অন্যদিকে বাস্তবতা বলছে অন্তত এবারকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখেই পুরো প্রক্রিয়া চলবে। এই নতুন বাস্তবতা ভারতের কূটনীতি ও নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে (আইআইসি) সম্প্রতি এই প্রশ্নগুলো নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ভারতের সাবেক আমলা, প্রাক্তন কূটনীতিক, নীতি বিশ্লেষক এবং শিক্ষাবিদরা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে নানা দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। কেউ মনে করছেন ভারতের উচিত ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ কৌশল অনুসরণ করা, অর্থাৎ নির্বাচন কীভাবে হয় এবং কে ক্ষমতায় আসে সেটা আগে দেখা। আবার কেউ কেউ মনে করছেন ভারত একেবারেই নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না, কারণ ভুল সরকার ক্ষমতায় এলে সেটার সরাসরি প্রভাব পড়বে ভারতের নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে।
আইআইসি-র আলোচনায় সাবেক আমলা ও তৃণমূল কংগ্রেসের সাবেক সাংসদ জহর সরকার বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভারতের মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তার মতে, জনগণ যাকেই ক্ষমতায় বসাবে দিল্লির উচিত তাকে মেনে নেওয়া। তিনি বলেন, হঠাৎ পালাবদল ভারতের জন্য একটা শকের মতো হলেও এখন সেটাকে বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে এখনকার যে সরকার সেটা কেবল অন্তর্বর্তীকালীন, তাই তাদের নিয়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন নেই। বরং অপেক্ষা করে দেখা উচিত কে আসল সরকার গঠন করে, তারপর সেই সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে।
কিন্তু সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ভিন্নমত প্রকাশ করেন। ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার হিসেবে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তার মতে, যদি ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনো শক্তি ক্ষমতায় আসে, তবে সেটা মেনে নেওয়া কেবল কঠিনই হবে না, বরং ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ভারত এড়িয়ে যেতে পারে না, বিশেষ করে যখন সেই দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন তাই ভারতের জন্য শুধু কূটনৈতিক ব্যাপার নয়, বরং নিরাপত্তা ও কৌশলগত গুরুত্বও বহন করে। শ্রিংলার মতে, ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি বলছে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে, কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব যখন তারা ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখে।
অন্যদিকে ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া ভারতের উপায় নেই। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি-সহ নানা দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার পর্যবেক্ষণ হলো, আওয়ামী লীগের প্রতি এখনও প্রবল ক্ষোভ বিদ্যমান, বিশেষ করে আন্দোলনে নিহত বা আহতদের পরিবারের মধ্যে। তাই অন্তত এই নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগকে বাইরে রাখা হচ্ছে এবং সেই সিদ্ধান্ত পাল্টানোর সম্ভাবনা কম। তার মতে, ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান জানানো, তা দিল্লির পছন্দ হোক বা না হোক। তিনি মনে করিয়ে দেন, ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভারত কখনো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের’ দাবি তোলেনি, অথচ এবার সে অবস্থান নিচ্ছে—যা ভারতের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে। ফলে ভারতের কৌশল হওয়া উচিত বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়া এবং যে সরকারই আসুক তাদের সঙ্গে কাজ করা।
এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বিতর্কিত প্রশ্নগুলোর একটি হলো জামায়াতে ইসলামীকে ভারত কীভাবে দেখবে। ঐতিহাসিকভাবে ভারত জামায়াতকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। তাদের ইসলামপন্থী আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার কারণে দিল্লি সবসময় তাদের অস্পৃশ্য মনে করেছে। কিন্তু এখন নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব জামায়াতকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে। তারা আধুনিক পোশাকে, টেলিভিশন টক শোতে হাজির হয়ে নিজেদের ভিন্নভাবে তুলে ধরছে। এমনকি তারা দাবি করছে, বাংলাদেশে শরিয়া আইন আনার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অতীতের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য জামায়াতের নেতারা প্রকাশ্যে ক্ষমাও চেয়েছেন।
শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন জামায়াত এখন ‘চার্ম অফেনসিভ’ চালাচ্ছে। তাদের নতুন নেতৃত্ব ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। কিন্তু শ্রিংলার মতো নীতি নির্ধারকেরা বিশ্বাস করেন জামায়াত কখনো তার চরিত্র পাল্টাতে পারে না। তাদের মতে, জামায়াত হলো মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশ, যাদের অতীত কর্মকাণ্ড ভারতের বিরুদ্ধে। তাই এই দলকে বিশ্বাস করা ভারতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, দিল্লি এখন এক অদ্ভুত দ্বিধার মধ্যে রয়েছে। একদিকে আছে দীর্ঘদিনের মিত্র আওয়ামী লীগ, যারা আপাতত রাজনীতি থেকে নির্বাসিত। অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত বা অন্যান্য দল যারা হয়তো নির্বাচনে অংশ নেবে, কিন্তু তাদের নিয়ে দিল্লির দোটানা প্রবল। ভারত যদি কেবল নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় থাকে, তবে নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করতে যায়, তবে বাংলাদেশি জনগণের কাছে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
এখন পর্যন্ত ভারতের সরকারি অবস্থান হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চাওয়া। কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বলছে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনই হতে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ভারতের সামনে তিনটি পথ খোলা—এক, বাস্তবতাকে স্বীকার করে যে সরকার আসবে তাদের সঙ্গে কাজ করা; দুই, নির্বাচনের আগে-পরে সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে ভারতের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা; তিন, জামায়াতসহ নতুন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ রক্ষা করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকা।
সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, ভারতের জন্যও এক বড় কূটনৈতিক পরীক্ষা। কে ক্ষমতায় আসে তার ওপর নির্ভর করবে দিল্লির ভবিষ্যৎ নীতি। এই মুহূর্তে দিল্লি সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও নির্বাচনের ফলাফলের পর দ্রুত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে অবস্থান নিতে হবে। কেননা, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ ভারতের জন্য অপরিহার্য প্রতিবেশী—এ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনের ওপর।
আপনার মতামত জানানঃ